রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন

5/5 - (1 vote)
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

এই নিবন্ধে তুলে ধরছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা কবি, সংগীতশিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, দার্শনিক। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রথম এশিয়ান, রবি ঠাকুর দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন। তার লেখা প্রচুর কবিতা, ছোট গল্প, নাটক এবং উপন্যাস যা পড়ে শেষ করা অসম্ভব। তাঁর রচনা “গীতাঞ্জলি” এবং “জীবন স্মৃতি” আজও আমাদের সকলের মনে চির স্মরণীয় হয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন

ছেলেবেলায় পৃথ্বীশের ডান দিকের কপালে চোট লেগেছিল ভুরুর মাঝখান থেকে উপর পর্যন্ত। সেই আঘাতে ডান চোখটাও সংকুচিত। পৃথ্বীশকে ভালো দেখতে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরটা কাটা দাগের অবিচারে সম্পূর্ণ হতে পারল না। অদৃষ্টের এই লাঞ্ছনাকে এত দিন থেকে প্রকাশ্যে পৃথ্বীশ বহন করে আসছে তবুও দাগও যেমন মেলায় নি তেমনি ঘোচে নি তার সংকোচ। নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হবার উপলক্ষে প্রত্যেকবার ধিক্‌কারটা জেগে ওঠে মনে। কিন্তু বিধাতাকে গাল দেবার অধিকার তার নেই।

তার রচনার ঐশ্বর্যকে বন্ধুরা স্বীকার করছে প্রচুর প্রশংসায়, শত্রুরা নিন্দাবাক্যের নিরন্তর কটুক্তিতে। লেখার চারি দিকে ভিড় জমছে। দু টাকা আড়াই টাকা দামের বইগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। সম্পাদকরা তার কলমের প্রসাদ ছুটোছাঁটা যা- ই পায় কিছুই ছাড়ে না। পাঠিকারা বলে, পৃথ্বীশবাবু মেয়েদের মন ও চরিত্র যেমন আশ্চর্য বোঝেন ও বর্ণনা করেন এমন সাধ্য নেই আর কোনো লেখকের। পুরুষ- বন্ধুরা বলে, ওর লেখায় মেয়েদের এত- যে স্তুতিবাদ সে কেবল হতভাগার ভাঙা কপালের দোষে। মুখশ্রী যদি অক্ষুণ্ন হত তা হলে মেয়েদের সম্বন্ধে সত্য কথা বাধত না মুখে। মুখের চেহারা বিপক্ষতা করায় মুখের অত্যুক্তিকে সহায় করেছে মনোহরণের অধ্যবসায়।


শ্রীমতী বাঁশরি সরকার ব্যারিস্টারি চক্রের মেয়ে- বাপ ব্যারিস্টার, ভাইরা ব্যারিস্টার। দু বার গেছে য়ুরোপে ছুটি উপলক্ষে। সাজে সজ্জায় ভাষায় ভঙ্গিতে আছে আধুনিক যুগের সুনিপুণ উদ্দামতা। রূপসী বলতে যা বোঝায় তা নয়, কিন্তু আকৃতিটা যেন ফ্রেঞ্চ পালিশ দিয়ে ঝকঝকে করা।
পৃথ্বীশকে বাঁশরি ঘিরে নিয়েছিল আপন দলের মধ্যে। পরিচয়ের আরম্ভকালে মানুষের বাক্যালংকারের সীমা যখন অনির্দিষ্ট থাকে সেইরকম একদা পৃথ্বীশ ওকে বলেছিল, পুরুষের প্রতিভা যদি হয় গাছের ফুল, মেয়েদের প্রভাব আকাশের আলো। কম পড়লে ফুলের রঙ খেলে না।

সাহিত্যের ইতিহাস থেকে প্রমাণ অনেক সংগ্রহ করছে। সংগ্রহ করবার প্রেরণা আপন অন্তরের বেদনায়। তার প্রতিভা শতদলের উপর কোনো- না কোনো বীণাপাণিকে সে অনেকবার মনে মনে আসন দিতে চেয়েছে, বীণা না থাকলেও চলে যদি বিলিত জ্যাজনাচের ব্যাঞ্জোও থাকে তার হাতে। ওর যে বাক্‌লীলা মাঝে মাঝে অবসন্ন হয়ে পড়ে তাকে আন্দোলিত করবার প্রবাহ সে চায় কোনো মধুর রসের উৎস থেকে। খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, কখনো মনে করে এ, কখনো মনে করে সে।


একটা গল্প লিখেছিল জয়দেবের নামটা নিয়ে তাকে বদনাম দিয়ে। যে কাহিনী গেঁথেছিল তার জন্যে পুরাবৃত্তের কাছে লেখক ঋণী নয়। তাতে আছে কবি জয়দেব শাক্ত; আর কাঞ্চনপ্রস্থের রাজমহিষী পদ্মাবতী বৈষ্ণব। মহিষীর হুকুমে কবি গান করতেন রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়ে। মহিষী শুনতেন পর্দার আড়ালে। সেই অন্তরালবর্তিনী কল্পমূর্তি জয়দেবের মনকে নিয়ে গিয়েছিল বৃন্দাবনের কুঞ্জছায়ায়। শক্তির মন্ত্র যিনি পেয়েছিলেন গুরুর কাছে তাঁর মনের রসের মন্ত্র ভেসে এল কেশধূপসুগন্ধীবেণীচুম্বিত বসন্ত- বাতাসে। লেখক জয়দেবের স্ত্রী মন্দাকিনীকে বানিয়েছিল মোটা মালমসলার ধুলোকাদা মাখা হাতে।

এই অংশে লেখকের অনৈতিহাসিক নিঃসংকোচ প্রগল্‌ভতার প্রশংসা করেছে একদল। মাটি খোঁড়ার কোদালকে সে খনিত্র নামে শুদ্ধি করে নেয় নি বলে ভক্তেরা তাকে খেতাব দিয়েছে নব্যসাহিত্যের পূর্ণচন্দ্র অর্থাৎ কলঙ্কগর্বিত। ছাপা হবার পূর্বেই বাঁশরি গল্পটা শুনেছে আপন চায়ের টেবিলে, নিভৃতে। অন্য নিমন্ত্রিতেরা উঠে গিয়েছিল, ওদের সেই আলাপের আদি পর্বে যশস্বী লেখককে তৃপ্ত করবার জন্যে চাটুবাক্যের অমিতব্যায়কে বাঁশরি আতিথ্যের অঙ্গ বলেই গণ্য করত। পড়া শেষ হতেই বাঁশরি চৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে ‘মাস্টারপীস, শেলির জীবনী নিয়ে ফরাসী লেখক এরিয়েল নাম দিয়ে যে গল্প লিখেছে তারই সঙ্গে এর কতকটা তুলনা মেলে; কিন্তু ওঃ।’ পৃথ্বীশের মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল।

চায়ের পেয়ালা দ্বিতীয়বার ভরতি করে নিয়ে তার মধ্যে চামচ সঞ্চালন করতে করতে বললে, ‘দেখুন শ্রীমতী বাঁশরি, আমার একটা থিয়োরি আছে, দেখে নেবেন একদিন, ল্যাবরেটরিতে তার প্রমাণ হবে। যে বিশেষ এনার্জি আছে মেয়েদের জৈবকণায়, যাতে দেহে মনে তাদের মেয়ে করেছে, সেইটেই কোনো সূক্ষ্ণ আকারে ব্যাপ্ত সমস্ত পৃথিবীতে। আচ্ছা, শ্রীমতী বাঁশরি, এটা আপনি কখনো কি নিজের মধ্যে অনুভব করেন না?’
বাঁশরি একটু ইতস্তত করছিল। পৃথ্বীশ বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই করেন এ আমি হলপ করে বলতে পারি। কীরকম সময়ে জানেন-
‘At that sweet time when winds are wooing
all vital things that wake to bring
News of birds and blossomings.’


বাঁশরি হাততালি দিয়ে উঠে বললে, ‘এতক্ষণে বুঝেছি আপনি কী বলছেন। মনে হয় যেন- ‘
পৃথ্বীশ কথাটাকে সম্পূর্ণ করে বললে, ‘যেন গোলাপ গাছের মজ্জার ভিতরে যে শক্তি বিনা ভাষায় অন্ধকারে কেঁদে উঠছে, বলছে ফুল হয়ে ফুটব সে আপনারই ভিতরকার প্রাণৌৎসুক্য। বার্গসঁ জানেন না, তিনি যাকে বলেন Elan Vital সেটা স্ত্রী- শক্তি।’
বাঁশরি পৃথ্বীশের কথাটা একটু বদলিয়ে দিয়ে বললে, ‘দেখুন পৃথ্বীশবাবু, নিজেকে ওই- যে ছড়িয়ে জানবার তত্ত্বটা বললেন ওটা মাটিতে তেমন মনে হয় না যেমন হয় জলে। জলের ঘাটে মেয়েদের একটা বিশেষ টান আছে, দেখেন নি কি?’


পৃথ্বীশ চমকে উঠে বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে ভাবালেন। কথাটা এতদিন মনে আসে নি। স্ত্রী- পুরুষে দ্বৈততত্ত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হল একমুহূর্তে। আর কিছু নয়, জল ও স্থল। মাটি ও বাতাসে যে অংশ জলীয় সেই অংশেই নারী ওই জলেই তো ধরণীর অনুপ্রেণনা।’
সেই দিন পৃথ্বীশ চঞ্চল হয়ে উঠে প্রথম বাঁশরির হাত চেপে ধরেছিল, বলেছিল, ‘ক্ষমা করবেন আমাকে, স্পষ্ট বুঝেছি পুরুষ তেমনি করেই নারীকে চায়, মরুভূমি যেমন করে চায় জলকে অন্তর্গূঢ় সৃষ্টিশক্তিকে মুক্তি দেবার জন্যে।’ কিছুক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে বাঁশরি হাত ছাড়িয়ে নিলে।

পৃথ্বীশ বললে, ‘দোহাই আপনার, আমাকে ব্যর্থতার হাত হতে বাঁচাবেন। এ আমার কেবল ব্যক্তিগত আবেদন নয়, আমি বলছি সমস্ত বাংলার সাহিত্যের হয়ে। আমি ইঁদারার মতো, জল দানের গভীর সঞ্চয় আছে আমার চিত্তে, কিন্তু তুমি নারী, জলের ঘট তোমার মাথায়।’ সেই দিন ওর সম্ভাষণ ‘আপনি’ হতে হঠাৎ ‘তুমি’তে এসে পৌঁছল, ইঙ্গিতেও আপত্তি উঠল না কোথাও।


বাঁশরিকে চিনত না বলেই সেদিন পৃথ্বীশ এতবড়ো প্রহসনের অবতারণা করতে পেরেছিল। বাঁশরি মখমলের খাপের থেকে নিজের ধারা[ লো] হাসি তখনো বের করে নি, হতভাগ্য তাই এমন নিঃশঙ্ক ছিল। ও ঠিক করে রেখেছিল আধুনিক কালচার্‌ড মেয়েরা চকোলেট ভালোবাসে আর ভালোবাসে কড়িমধ্যমে ভাবুকতা।
এর পর থেকে এই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের প্রতিভায় প্রাণ সঞ্চার করবার একমাত্র দায়িত্ব নিলে বাঁশরি।

হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলে পুরুষ- বন্ধুরা, মেয়ে বন্ধুরা ওর সজীব সম্পত্তিটিকে নিয়ে ঠিক লোভ করে নি ঈর্ষা করেছিল। ইংরেজ অ৻াটর্নি আপিসের শিক্ষানবিশ সুধাংশু একদিন পৃথ্বীশের রিফু- করা মুখ নিয়ে কিছু বিদ্রূপ করেছিল, বাঁশরি বললে, ‘দেখো মল্লিক ওর মুখ দেখতে আমার পজিটিভলি ভালো লাগে।’
‘ভালো লাগে’, সুধাংশু হো হো করে হেসে উঠল। বললে, ‘মডার্‌ন আর্ট বুঝতে আমাদের সময় লাগবে।’
বাঁশরি বললে, ‘বিধাতার তুলিতে সাহস আছে, যাকে তিনি ভালো- দেখতে করতে চান তাকে সুন্দর করা দরকার মনে করেন না। তাঁর মিষ্টান্ন তিনি ছড়ান ইতর লোকদেরই পাতে।’
সুধাংশু বললে, ‘গাল খেলুম তোমার কাছে, এটা সইতে চেষ্টা করব। কিন্তু ভাগ্যে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং দেন নি গাল।’ ব’লে সে ঘোড়দৌড় দেখতে চলে গেল। বাঁশরিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে প্ল্যান ছিল মনে, সেটা ত্যাগ করলে।


পার্টি জমেছে বাগানে, সুষমার বাপ গিরিশ সেনের বাড়িতে। বাগানের দক্ষিণ দিকে তিনটে ঝাউগাছ চক্র করে দাঁড়িয়ে, তার তলায় কাঠের আসন, সেই আসনে বসে আছে পৃথ্বীশ।
এই দলের এরকম পার্টিতে পৃথ্বীশের এই প্রথম প্রবেশ। অনেক ভেবেছিল নিজের সাজ নিয়ে।
যে এন্ডির চাদরটা পরেছে এখানে এসে হঠাৎ দেখতে পেলে তার এক কোণে মস্ত একটা কালির দাগ। চারি দিকে ফিটফাটের ফ্যাশন, তারি মাঝখানে কালিটা যেন চেঁচিয়ে উঠছে। অভ্যাগত শৌখিনদের মধ্যে ধুতিপরা মানুষও আছে কিন্তু চাদর কারো গায়েই নেই।

পৃথ্বীশ নিজেকে বেখাপ বলে অনুভব করলে, স্বস্তি পেলে না মনে। কোণে বসে বসে দেখলে কেউ বা আলাপ করছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে, কেউ বা খেলছে টেনিস, কেউ বা টেবিলে সাজানো আহার্য ভোগ করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। উঠে দাঁড়ানো বা চলে বেড়ানো ওর পক্ষে অসাধ্য হল। রাগ হচ্ছে বাঁশরির ‘পরে। চক্রান্ত করে সেই ওকে এখানে এনে হাজির করেছে। আনবার একটা কারণও ঘটেছিল। সেটি বলি।’বেমানান’ নাম দিয়ে কিছুদিন আগেই পৃথ্বীশ একটা ছোটগল্প লিখেছিল।


বিষয়টা এই-
দেওঘরে নলিনাক্ষের মস্ত দো- মহলাবাড়ি। পুজোর ছুটিতে এক মহলে আশ্রয় নিয়েছে নবকান্ত মুখুজ্জেরা। তাদের মেয়েরা নিষ্ঠাবতী, মুখ্যভাবে দেবদর্শনে পুর্ণ এবং গৌণভাবে ইঁদারার জলে ক্ষুধাবৃদ্ধি এই দুটোই তাদের মনে প্রবল। বৈঠকখানা ঘর থেকে কার্পেট উঠিয়ে দিয়েছে, সেখানেও শুচিতা বিস্তারের জন্যে চলছে জল- ঢালাঢালি। এ দিকে অন্য মহলে মোরগ মাংস- লোলুপ নলিনাক্ষের দলদল। এই দলের একজন এম. এসসি. পরীক্ষার্থী অপর দলের কোনো পূজাপরায়ণা কুমারীকে হৃদয় সমর্পণ করেছিল, তারই ট্র্যাজেডি এবং কমেডি খুব জোরালো রসালো ভাষায় বর্ণনা করেছে পৃথ্বীশ। এক পক্ষের পাঠক বাহবা দিয়েছিল প্রচন্ড জোরে, বলা বাহুল্য বাঁশরি সে পক্ষের নয়।


বাঁশরি বললে, ‘দেখো পৃথ্বীশবাবু, তুমি যে ছুরি চালিয়েছ ওটা যাত্রার দলের ছুরি, কাঠের উপরে রাঙতা মাখানো, ওতে যারা ভোলে তারা পাড়াগেঁয়ে অজ্‌বুগ তাদের জন্য সাহিত্য নয়।’
পৃথ্বীশ হেসে উড়িয়ে দেবার জন্য বললে, ‘কাজ হয়েছে দেখছি, বিঁধছে বুকে।’
‘আমাকে বেঁধে নি, বিঁধেছে তোমার খ্যাতির ভাগ্যকে। বানিয়ে গাল দেয় পাঁচালির দল, হাটের- আসরে লোক হাসাবার জন্যে, তুমি কি সেই দলের লিখিয়ে নাকি? তা হলে দন্ডবৎ।’
পৃথ্বীশ গালটাকে অগ্রসর হয়ে মেনে নেবার জন্যে বললে, ‘ভাষায় বলে খুরে দন্ডবৎ। এত দিনে খুর ধরা পড়ল বুঝি।’


‘ধরা পড়ত না, যদি- না সিংহের থাবা চালাবার ভান করতে। একটা কথা জিজ্ঞসা করি, মশায়, যাকে নলিনাক্ষের দল বলে এত ইনিয়ে বিনিয়ে কলম চালিয়েছ তাকে তুমি সত্য করে জান কি?’
পৃথ্বীশ বললে, ‘লেখার জন্যে জানবার দরকার করে না, বানিয়ে বলবার বিধিদত্ত অধিকার আছে লেখকের, আদালতের সাক্ষীর নেই।’
‘ওটা তো খাঁটি লেখকের লেখা নয়। ভিস্তির জলকে ঝরনার জল বলে না। সমাজের আবর্জনা ঝাঁটাবার জন্যে কোমর বেঁধেছিলে। আন্দাজে চলে না ও কাজ। আবর্জনাও সত্য হওয়া চাই আর ঝাঁটা- গাছটাও, সঙ্গে চাই ব্যাবসায়ীর হাতটা।’


পৃথ্বীশ যখন একটা ঝকঝকে জবাবের জন্যে মনের মধ্যে হাতড়াচ্ছে এমন সময় বাঁশরি বললে, ‘শোন পৃথ্বীশবাবু, যাদের চেন না, তাদের চিনতে কতক্ষণ। আমরা তোমার ওই নলিনাক্ষের দল, আমাদের অপরাধ ঢের আছে, যেমন তোমাদেরও আছে বিস্তর। ভালো করে জানা হলে মানুষকে ভালো লাগতে পারে মন্দ লাগতেও পারে, কিন্তু অদ্ভুত লাগে না।’
‘তোমকে তো জেনেছি বাঁশি, কী রকম লাগছে তার প্রমাণ কিছু কিছু পেয়েছ বোধ করি।’
‘আমাকে কিছু জান না তুমি। আগে চেষ্টা করো আমার চারি দিককে জানতে।’
‘কী উপায়?’
‘উপায় আমিই ঠিক করে দেব।’


সেই উপায়ের প্রথম আরম্ভ আজকের এই পার্টিতে। সুষমা ছোটো বোন সুষীমা, মাথায় বেণী দোলানো, বয়েস হবে তেরো, কাঁচা মুখ, চোখে চশমা, চটপট করে চলে- পৃথ্বীশকে এসে বললে, ‘চলুন খেতে।’
পৃথ্বীশ একবার উঠি- উঠি করলে, পর মুহূর্তে চেপে বসল শক্ত হয়ে। হিসেব করে দেখলে বিশ- পঁচিশ হাত তফাতে আছে টেবিলটা, এন্ডির চাদর দুলিয়ে যেতে হবে অনেক নরনারীর চোখের সামনে দিয়ে। ফস ক’রে মিথ্যে কথা বললে, ‘আমি তো এখন চা খাই নে।’
সুষীমা ছেলেমানুষের মতো বললে, ‘কেন, এই সময়েই তো সবাই চা খায়।’
পৃথ্বীশ এই ছেলেমানুষের কাছেও সাহিত্যিকের চাল ছাড়তে পরলে না, মুখ টিপে বললে, ‘এক- এক মানুষ থাকে যে সবাইয়ের মতো নয়।’


সুষীমা কোনো তর্ক না করে আবার বেণী দুলিয়ে চটপট করে ফিরে চলে গেল।
সুষীমার মাসি অর্চনা দূর থেকে দেখলে। বুঝলে, যত বড়ো খ্যাতি থাক্‌, লোকটির সেই লজ্জা প্রবল যেটা অহংকারের যমজ ভাই। ছোটো একটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিজের হাতে করে নিয়ে এল। সামনে ধরে বললে, ‘খাবেন না, সেকি কথা পৃথ্বীশবাবু, কিছু খেতেই হবে।’


অন্তর্যামী জানেন খাওয়ার প্রয়োজন জরুর হয়ে উঠেছিল। প্লেটটা পৃথ্বীশ কোলে তুলে নিলে। নিতান্ত অপর সাধারণের মতোই খাওয়া শুরু করলে। বেঞ্চির এক ধারে বসল অর্চনা। দোহারা গড়নের দেহ, হাসিখুশি ঢলঢলে মুখ। বললে, ‘সেদিন আপনার ‘বেমানান’ গল্পটা পড়লুম পৃথ্বীশবাবু। পড়ে এত হেসেছি কী আর বলব।’ যদি কোনোমতে সম্ভবপর [ হত ] তা হলে রাঙা হয়ে উঠত পৃথ্বীশের মুখ। কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। একখানা কেকের উপর অত্যন্ত মনোযোগ দিলে মাথা নীচু করে।


‘আপনি নিশ্চয়ই কাউকে লক্ষ্য করে লিখেছেন। অমন অদ্ভুত জীবের নমুনা স্বচক্ষে না- দেখলে সাহস করে লেখা যায় না। ওই যে- জায়গায় মিস্টার কিষেণ গাপটা বি. এ. ক্যান্টাব পিছন থেকে মিস লোটিকার জামার ফাঁকে নিজের আঙটি ফেলে দিয়ে খানাতল্লাশির দামি করে হোহা বাধিয়ে দিলে। আমার বন্ধুরা সবাই পড়ে বললে, সাহিত্যে এ জায়গাটা একেবারে অতুলনীয়। আপনার লেখা ভয়ানক রিয়ালিস্টিক, পৃথ্বীশবাবু। ভয় হয় আপনার সামনে দাঁড়াতে।’
সিঙাড়ার গ্রাসটা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে পৃথ্বীশ বললে, ‘আপনাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর তার বিচার করুন বিধাতা পুরুষ।’


‘না, ঠাট্টা করবেন না। আপনি ওস্তাদমানুষ, আপনার সঙ্গে ঠাট্টায় পারব না। সত্যি করে বলুন, এরা কি আপনার বন্ধু, নিশ্চয়ই এদের খুব আত্মীয়ের মতোই জানেন। ওই যে মেয়েটা, কী তার নাম, কথায় কথায় হাঁপিয়ে উঠে বলে, মাই আইজ্‌ ও গড্‌, যে মেয়েটা লাজুক স্যান্ডেলের সংকোচ ভাঙাবার জন্যে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইচ্ছে করে গাড়ি খাদের মধ্যে ফেলেছিল। প্ল্যান করেছিল মিস্টার স্যান্ডেলকে দু হাতে তুলে ধরে পতিতোদ্ধার করবে- হবি তো হ, স্যান্ডেলের হাতে হল কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার- কী ড্রামাটিক্‌!

রিয়ালিজমের একেবারে চূড়ান্ত। ভালোবাসার এত বড়ো আধুনিক পদ্ধতি বেদব্যাসের জানা ছিল না- ভেবে দেখুন সুভদ্রার কত বড়ো চান্স মারা গেল, আর অর্জুনেরও কবজি গেল বেঁচে।’
‘আপনিও তো কম মডার্ন নন- আমার মতো নির্লজ্জকেও লজ্জা দিতে পারেন।’
‘কী কথা বলেন পৃথ্বীশবাবু, বিনয় করবেন না। আপনি নির্লজ্জ? লজ্জায় গলা দিয়ে সন্দেশ চলবে না। কলমটার কথা স্বতন্ত্র।’


পৃথ্বীশ মনে মনে বললে, ‘বাস রে দেখতে এমন নিটোল কোমল, মনটা কী চমৎকার নিষ্ঠুর। বেমানানের ষোলো আনা শোধ না নিয়ে ছাড়বেন না।’
এখনো বাঁশরির দেখা নেই। হঠাৎ পৃথ্বীশের মনে হল, হয়তো সবটাই তাকে শাস্তি দেবার ষড়যন্ত্র। রাগ হল বাঁশরির ‘পরে, মনে মনে বললে, আমারও পালা আসবে।
এমন সময় কাছে এসে উপস্থিত রাঘুবংশিক চেহারা শালপ্রাংশুর্মহাপ্রভুজঃ সোমশংকর। গৌরবর্ণ, রোদেপুড়ে কিছু ছায়াচ্ছন্ন, ভারী মুখ, দাড়ি গোঁফ কামানো, চুড়িদার সাদা পায়জামা, চুড়িদার সাদা আচকান, মাথায় সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি- কায়দায় পাগড়ি, পায়ে শুঁড়তোলা দিল্লির নাগরাজুতো, দেহটা যে ওজনের কন্ঠস্বরটাও তেমনি। পৃথ্বীশের বুঝতে বাকি নেই, এই লোকটাই আজকের দিনের প্রধান নায়ক। অর্চনা পরস্পরের পরিচয় উপলক্ষে বললে, ‘রাজা বাহাদুর সোমশংকর রায়।’


পৃথ্বীশের মনটা পুলকিত হয়ে উঠল, শৌখিন পার্টিতেও সাহিত্যিকের সম্মান ছাড়িয়ে উঠেছে আভিজাত্যের খেতাবকে। যেচে আসছে আলাপ করতে। এতক্ষণ সংকোচে পীড়িত পৃথ্বীশ উৎকন্ঠিত হয়ে অগমন প্রতীক্ষা করছিল বাঁশরির, ও- যে ‘সর্বত্র পূজ্যতে’র দলে সেইটে প্রমাণ করবার জন্যে। আর প্রয়োজন রইল না- এমন- কি, ভুলে গেল এন্ডির চাদরের কালির চিহ্ন।
অর্চনা চলে গেল অন্য অতিথিদের সেবায়।
সোমশংকর জিজ্ঞাসা করলে, ‘বসতে পারি?’
পৃথ্বীশ ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘নিশ্চয়।’


রাজা বাহাদুর বললে ‘আপনার কথা প্রায়ই শুনতে পাই মিস বাঁশরির কাছ থেকে। তিনি আপনার ভক্ত।’
‘ঈর্ষা করবার মতো নয়। ওঁর ভক্তিকে অবিমিশ্র বলা যায় না। তাতে ফুল যা পাই সেটা ঝরে পড়ে, কাঁটাগুলো বরাবর থাকে বিঁধে।’
‘আপনার একখানা বই পড়েছিলুম, মনে হচ্ছে তার নাম রক্তজবা। চমৎকার, হিরোয়িন যার নাম রাগিণী সে দেখলে স্বামীর মন আর- একজনের ‘পরে, তখন স্বামীকে মুক্তি দেবে বলে মিথ্যে চিঠি বানালে, প্রমাণ করতে চাইলে ও নিজেই ভালোবাসে প্রতিবেশী বামন দাসকে- সে জায়গাটায় লেখার কী জোর আর কী ওরিজিনাল আইডিয়া।’


পৃথ্বীশ চমকে উঠল। এও কি শাস্তির উদ্দেশে তার প্রতি ইচ্ছাকৃত ব্যঙ্গ, না দৈবকৃত গলদ। রক্তজবা বইখানা যতীন ঘটকের। যতীন পৃথ্বীশের প্রতিযোগী, সকলেই জানে। উভয়ের উৎকর্ষ বিচার নিয়ে রুচির সংঘাত মাঝে মাঝে শোকাবহ হয়ে ওঠে এটা কি ওই সম্মুখবর্তী অতিকায় জীবের স্থূল বুদ্ধির অগোচর। রক্তজবায় স্বামীপ্রেমে বঙ্গনারীর কলঙ্ক স্বীকারের অসামান্য বিবরণে বাঙালি পাঠকের বিগলিত হৃদয় শুধু কেবল ছাপানো বইয়ের পাতাকেই বাষ্পাকৃত করেছে, তা নয়, সিনেমা থিয়েটারেও তার আর্দ্রতা প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। এই সাধারণ বাঙালি পাঠক ও দর্শকের অশিক্ষিত রুচির প্রতি যে পৃথ্বীশ অপরিসীম অবজ্ঞা অনুভব করে সেই মানুষেরই ‘পরে ভাগ্যের এই বিচার।


একটা রূঢ় কথা ওর মুখ দিয়ে বেরচ্ছিল, এমন সময় [ বাঁশরি ] অলক্ষ্য পথ দিয়ে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালে। ওকে দেখেই সোমশংকর চমকে দাঁড়িয়ে উঠল, লাল হয়ে উঠল তার মুখ। বাঁশরি বললে, ‘শংকর, আজ আমার এখানে নেমন্তন্ন ছিল না। ধরে নিচ্ছি সেটা আমার গ্রহের ভুল নয়, গৃহকর্তাদেরই ভুল, সংশোধন করবার জন্যে এলুম। সুষমার সঙ্গে আজ তোমার এনগেজমেন্টের দিন, অথচ এ সভায় আমি নেই এ কখনো হতেই পারে না। খুশি হও- নি অনাহূত এসেছি বলে।’
‘খুব খুশি হয়েছি সে কি বলতে হবে।’


‘সে কথাটা ভালো ক’রে বলবার জন্যে চলো ওই ফোয়ারার ধারে ময়ূরের ঘরের কাছে। পৃথ্বীশবাবু নিশ্চয়ই প্লটের জন্য একমনে ছিপ ফেলে বসে আছেন, ওঁর ওই অবকাশটা নষ্ট করলে বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি হবে। দেখছ- না সর্বসাধারণ থেকে অসীম দূরে এক কোণে আছেন বসে।’
সোমশংকরের হাতে হাত ঝুলিয়ে বাঁশরি চলে গেল ময়ূরের ঘরের দিকে। পুকুরের মাঝখানে ফোয়ারা। ঘাটের পাশে চাঁপা গাছ। গাছের তলায় ঘাসের উপর বসল দুজনে। সোমশংকর সংকোচ বোধ করলে, সবাই তাদের দূর থেকে দেখছে। কিন্তু বাঁশরির ইঙ্গিত অবহেলা করবার শক্তি নেই তার রক্তে। পুলক লাগল ওর দেহে। বাঁশরি বললে, ‘সময় বেশি নেই, কাজের কথাটা এখনি সেরে ছুটি দেব। তোমার নতুন এনগেজমেন্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জাল জমেছে, সেগুলো সাফ করে ফেললে পথটা পরিষ্কার হবে। এই নাও।’

এই বলে একটা পান্নার কন্ঠী, হীরের ব্রেসলেট, একটা মুক্তো বসানো বড়ো গোল ব্রোচ ফুলকাটা রেশমের থলি থেকে বের করে সোমশংকরকে দেখিয়ে আবার থলিতে ভ’রে তার কোলের উপর ফেলে দিলে। থলিটা বাঁশরির নিজের হাতের কাজ করা। সোমশংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘বাঁশি, জানো আমার মুখে কথা জোগায় না। যতটুকু বলতে পারলেম না তার সব মানে নিজে বুঝে নিয়ো।’ বাঁশরি দাঁড়িয়ে উঠল। বললে, ‘সব কথাই আমার জানা, মানে আমি বুঝি। এখন যাও, তোমাদের সময় হল।’
‘যেয়ো না বাঁশি, ভুল বুঝো না আমাকে। আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। আমি জঙ্গলের মানুষ শহরে এসে কলেজে পড়া আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা। সে দৈবের খেলা। তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে। তার দাম কিছুতে শোধ হবে না। তুচ্ছ এই গয়নাগুলো।’


‘আমার শেষ কথাটা শোনো শংকর। আমার তখন প্রথম বয়েস, তুমি এসে পড়লে সেই নতুন- জাগা অরুণ রঙের মধ্যে, ডাক দিয়ে বাইরে আনলে যাকে তাকে নাও বা না নাও, নিজে তো তাকে পেলুম। আত্মপরিচয় ঘটল, বাস। দুই পক্ষের হয়ে গেল শোধবোধ। এখন দুইজনে অঋণী হয়ে আপন- আপন পথে চললুম, আর কী চাই।’ সোমশংকর থলিটা পকেটের মধ্যে পুরে গয়নাগুলো ফেলে দিলে পুকুরে। বাঁশরি দ্রুতপদে চলে গেল যেখানে বসে আছে পৃথ্বীশ। সকলেরই লক্ষ্যগোচর ভাবে বসল তার পাশে। প্রশ্রয় পেয়ে পৃথ্বীশ একটু ঝগড়ার সুরে বললে, ‘এত দেরি করে এলে যে।’
‘প্রমাণ করবার জন্যে যে বাঘ- ভাল্লুকের মধ্যে আসো নি। সবাই বলে উপন্যাসের নতুন পথ খুলেছ নিজের জোরে, আর এখানকার এই পুতুল নাচের মেলায় পথটা বের করতে ওফিস্যাল গাইড চাই, লোকে যে হাসবে।’


‘পথ না পাই তো অন্তর গাইডকে তো পাওয়া গেল।’ এই বলে একটু ভাবের ঝোঁক দিয়ে ওর দিকে তাকালে। এই রকম আবিষ্ট অবস্থায় পৃথ্বীশের মুখের ভঙ্গি বাঁশরি সইতে পারত না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ‘সস্তা মিষ্টান্নের কারবার শুরু করতে আজ ডাকি নি তোমাকে। সত্যি করে দেখতে শেখো, তার পরে সত্যি করে লিখতে শিখতে পারবে। অনেক মানুষ অনেক অমানুষ আছে চারি দিকে, ঠাহর করলেই চোখে পড়বে।’
‘নেই বা দেখলুম, তোমার কী তাতে?’
‘লিখতে যে পারি নে পৃথ্বীশ। চোখে দেখি মনে বুঝি। ব্যার্থ হয় যে সব। ইতিহাসে বলে একদিন বাংলা দেশে কারিগরদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল। আমিও কারিগর, বিধাতা বুড়ো আঙুলটা কেটে দিয়েছেন। আমদানি করা মালে কাজ চালাতে হয়। সেটা কিন্তু সাচ্চা হওয়া চাই।’

এমন সময় কাছে এল সুষমা।
সুষমাকে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। সচরাচর এরকম চেহারা দেখা যায় না। লম্বা সতেজ সবল, সহজ মর্যাদায় সমুন্নত, রঙ যাকে বলে কনক গৌর, ফিকে চাঁপার মতো, কপাল নাক চিবুক স্পষ্ট করে যেন কুঁদে তোলা।
সুষমা পৃথ্বীশকে একটা নমস্কার করে বাঁশরিকে বললে, ‘বাঁশি কোণে লুকিয়ে কেন?’
‘কুনো সাহিত্যিককে বাইরে আনবার জন্যে। সম্প্রতি বেকার হওয়াতে এই দায়িত্বটা নিয়েছি- দিন কাটছে একরকম। খনির সোনাকে শানে চড়িয়ে নাম করতে পারব। পূর্ব হতেই হাতযশ আছে। জহরৎকে দামি করে তোলে জহরী, পরের ভোগের জন্যে। সুষী, ইনিই হচ্ছেন পৃথ্বীশবাবু জানো বোধহয়।’
‘খুব জানি, এই সেদিন পড়ছিলুম, এঁর ‘বোকার বুদ্ধি’ গল্পটা। কাগজে কেন এত গাল দিয়েছে বুঝতেই পারলুম না।’


পৃথ্বীশ বললে, ‘অর্থাৎ বইটা এমনিই কি ভালো।’
‘ও- সব ধারালো কথা বলবার ভার বাঁশরির উপর। আমি সময় পেলে শুধু পড়ি, তার পরে বলতে কিছু সাহস হয় না, পাছে ধরা পড়ে কালচারের খাক্‌তি।’
বাঁশরি বললে, ‘বাংলার মানুষ সম্বন্ধে গল্পের ছাঁচে ন্যাচরল হিসট্রি লিখছেন পৃথ্বীশবাবু, যেখানটা জানেন না দগদগে রঙ দেন লেপে মোটা তুলি দিয়ে। রঙের আমদানি সমুদ্রের ওপার থেকে। দেখে দয়া হল। বললুম, জীবজন্তুর সাইকোলজির খোঁজে গুহা- গহ্বরে যেতে যদি খরচে না কুলোয় জুওলজিকালের খাঁচাগুলোর ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিপাত করতে দোষ কী?’
‘তাই বুঝি এনেছ এখানে?’


‘পাপ মুখে বলব কী করে তা কবুল করছি। পৃথ্বীশবাবুর হাত পাকা, কিন্তু মালমসলাও তো পাকা হওয়া চাই। যতদূর সাধ্য, জোগান দেবার মজুরিগিরি করছি। এর পরে যে জিনিস বেরবে পৃথিবী চমকে উঠবে, নোবেল প্রাইজ কমিটি পর্যন্ত।’
‘ততদিন অপেক্ষা করব। ইতিমধ্যে আমাদের ওদিকে চলুন। সবাই উৎসুক হয়ে আছে আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য। মেয়েরা অটোগ্রফের খাতা নিয়ে ঘুরছে কাছে আসতে সাহস নেই। বাঁশি, একলা ওঁকে বেড়া দিয়ে রাখলে অনেকের অভিশাপ কুড়োতে হবে।’


বাঁশরি উচ্চহাস্যে হেসে উঠল।’সেই অভিশাপই তো মেয়েদের বর। সে তুমি জানো। রাজারা দেশ জয় করত ধন লুঠের জন্যে। মেয়েদের লুঠের মাল প্রতিবেশিনীদের ঈর্ষা।’ একথার উত্তর না দিয়ে সুষমা বললে, ‘পৃথ্বীশবাবু, গন্ডি পেরোবার স্বাধীনতা যদি থাকে একবার যাবেন ওদিকটাতে’- এই বলে চলে গেল।
পৃথ্বীশ তখনি বলে উঠল, ‘কী আশ্চর্য ওকে দেখতে। বাঙালি ঘরের মেয়ে বলে মনেই হয় না- যেন এথীনা, যেন মিনার্ভা, যেন ব্রূন্‌ হিল্ড।’


উচ্চস্বরে হাসতে লাগল বাঁশরি। বলে উঠল, ‘যত বড়ো দিগ্‌গজ পুরুষ হোক- না সবার মধ্যেই আছে আদিম যুগের বর্বর। নিজেকে হাড়পাকা রিয়ালিস্ট বলে দেমাক করো, ভান করো মন্তর মান না। এক পলকে লাগল মন্তর, উড়িয়ে নিয়ে গেল মাইথলজিক যুগে। মনটা তোমাদের রূপকথার, সেইজন্যেই কোমর বেঁধে কলমটাকে টেনে চলেছ উজানপথে। দুর্বল ব’লেই বলের এত বড়াই।’
পৃথ্বীশ বললে, ‘সে কথা মাথা হেঁট করে মানব, পুরুষ জাত দুর্বল জাত।’
বাঁশরি বললে, ‘তোমরা আবার রিয়ালিস্ট! রিয়ালিস্ট মেয়েরা। আমরা মন্তর মানি নে। যতবড়ো স্থূল পদার্থ হও, তোমরা যা, তোমাদের তাই বলেই জানি। রঙ আমরা মাখাই নে তোমাদের মুখে, মাখি নিজে।

রূপকথার খোকা সব, মেয়েদের কাজ হয়েছে তোমাদের ভোলানো। পোড়া কপাল আমাদের। এথীনা, মিনার্ভা! হায় রে হায়! ওগো রিয়ালিস্ট, এটুকু বুঝতে পার না যে, রাস্তায় চলতে যাদের দেখেছ পানওয়ালির দোকানে এঁকেছ কড়া তুলিতে যাদের মূর্তি, তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এথীনা, মিনার্ভা।’
বাঁশরির ঝাঁঝ দেখে পৃথ্বীশ মনে মনে হাসলে। বললে, ‘বৈদিক কালে ঋষিদের কাজ ছিল মন্তর পড়ে দেবতা ভোলানো। – কিন্তু যাঁদের ভোলাতেন তাঁদের ভক্তি করতেন। তোমাদের যে সেই দশা দেখি বাঁশি। বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা, আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না, এমনি করে মাটি করলে এই জাতটাকে।’
‘সত্যি সত্যি, খুব সত্যি! ওই বোকাদের আমরা বসাই উঁচু বেদীতে, চোখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই, নিজেদের অপমানের শেষ করি, যত ভোলাই তার চেয়ে হাজার গুণে ভুলি।’
পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘এর উপায় কী।’


বাঁশরি বললে, ‘তাই তো বলি অন্তত লেখবার বেলায় সত্যি কথাটা লেখো। আর মন্তর নয় মাইথলজি নয়। মিনার্ভার মুখোশটা খুলে একবার দেখো। সেজেগুজে পানের ছিপে ঠোঁট লাল করে তোমাদের পানওয়ালি যে মন্তরটা ছড়ায়, ওই আশ্চর্য মেয়েও ভাষা বদলিয়ে সেই মন্তরই ছড়াচ্ছে। সামনে পড়েছে পথচলতি এক রাজা, তাঁকে ভোলাতে বসেছে কিসের জন্যে? টাকার জন্যে। শুনে রাখো, টাকা জিনিসটা মাইথলজি নয়, ওটা ব্যাঙ্কের। ওটা তোমাদের রিয়ালিজমের কোটায়।’
পৃথ্বীশ বললে, ‘টাকার প্রতি ওঁর দৃষ্টি আছে সেটাতে বুদ্ধির পরিচয় পওয়া গেল, সেইসঙ্গে হৃদয়টাও থাকতে পারে।’


‘আছে গো আছে। ঠিক জায়গায় খুঁজে দেখলে দেখতে পাবে পানওয়ালিরও হৃদয় আছে, কিন্তু টাকা এক দিকে হৃদয়টা আর- এক দিকে। এইটে যখন আবিষ্কার করবে তখন গল্প জমবে। পাঠিকারা ঘোর আপত্তি করবে, বলবে মেয়েদের খেলো করা হল, অর্থাৎ তাদের মন্ত্রশক্তিতে বোকাদের মনে খট্‌কা লাগানো হচ্ছে। উঁচু দরের পুরুষ পাঠকেরা গালি পাড়বে, তাদের মাইথলজির রঙ চটিয়ে দেওয়া, সর্বনাশ। কিন্তু ভয় কোরো না পৃথ্বীশ, রঙ যখন যাবে জ্বলে, মন্ত্র যখন পড়বে চাপা- তখনো সত্য থাকবে টিকে।’


‘ওর হৃদয়ের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? অসভ্যতা হবে, কিন্তু লেখক তো ড্রয়িংরুমের পোষা ভদ্রলোক নয়, সে অত্যন্ত আদিম শ্রেণীর সৃষ্টিকর্তা, চতুর্মুখের তুল্য কিংবা প্রলয়কর্তা দিগম্বরের স্বজাত।’
‘ঠিকানা বলতে হবে না, নিজের চোখেই দেখতে পাবে চোখ যদি থাকে। এখন চলো ওইদিকে, তোমাকে নিয়ে ওদের মধ্যে প্রসাদ ভাগ করে দেই গে।’


‘তোমার প্রসাদ?’
‘হ্যাঁ, আমারই প্রসাদ। আমার নিন্দে দিয়েই এর স্বাদটা হয়ে উঠেছে উপাদেয়।’
‘দুঃখের কথা জানাই তোমাকে বাঁশরি। চাদরটাতে মস্ত একটা কালির দাগ। অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে পাই নি।’
‘এখানে কারো কাপড়ে কোনো দাগ নেই, তা দেখেছ?’
‘দেখেছি।’
‘তা হলে জিত রইল একা তোমারই। তুমি রিয়ালিস্ট, ওই কালির দাগ তোমার ভূষণ। আজও খাঁটি হয়ে ওঠনি বলেই এতক্ষণ লজ্জা করছিলে।’
‘তুমি আমাকে খাঁটি করে তুলবে?’
‘হাঁ, তুলব, যদি সম্ভব হয়।’


বাঁশরির প্রত্যেক কথায় পৃথ্বীশের মনটা যেন চুমুকে মদ খাচ্ছে। এই দলের মেয়ের সঙ্গে এই ওর প্রথম আলাপ। অপরিচিতের অভিজ্ঞতায় মনটা পথ হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে পদে পদে। কোন্‌ কথাটা পৌঁছোয় কোন্‌ অর্থ পর্যন্ত, কতদূর পা বাড়ালে পড়বে না গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঠাহর করে উঠতে পারছে না। এই অনিশ্চয়তা মনকে উদ্‌ভ্রান্ত করে রেখেছে দিনরাত।

যে কথার যে উত্তর দেয় নি বাড়িতে ফিরে এসে সেইটে ও বাজাতে থাকে, ঠিক সময় কেন মনে আসে নি ভেবে হায় হায় করে। বাঁশরি ওকে অনেকটা প্রশ্রয় দিয়েছে, তবু পৃথ্বীশ বিষম ভয় করে তাকে। নিজেকে ধিক্‌কার দিয়ে বলে সাহসী পুরুষের স্পর্ধাকেই পুরস্কৃত করে মেরেরা, যারা ওদের সসংকোচে পথ ছেড়ে দেয়, বঞ্চিত হয় তারাই। নিজের দৃঢ় বিশ্বাস, ওর গোঁয়ার্তুমি যদি হত খাঁটি গিনি সোনার দরের, বাজালে ঠন্‌ করে উঠত, তা হলে মেয়ে মহলে উড়ত ওর জয়- পতাকা।

পুরুষের উপকরণে বিভীষিকা বীভৎসতার দাম আছে ওদের কাছে।
পৃথ্বীশ স্পষ্ট বুঝেছে যে, নিজেদের সমাজের উপর বাঁশরির জোর দখল। ওকে সবাই যে ভালোবাসে তা নয়, কিন্তু তুচ্ছ করবার শক্তি নেই কারো। তাই সে যখন স্বয়ং পৃথ্বীশকে পাশে করে নিয়ে চলল আসরের মধ্যে, পৃথ্বীশ তখন মাথাটা তুলেই চলতে পারলে, যদিও লক্ষ্মীছাড়া এন্ডিচাদরের কালির লাঞ্ছনা মন থেকে সম্পূর্ণ ঘোচে নি।


জনতার কেন্দ্রস্থলে এসে পৌঁছল, কিন্তু ওর উপর থেকে সমবেত সকলের লক্ষ্য তখন গেছে সরে।
সবেমাত্র উপস্থিত হয়েছে আর- একটি লোক তার উপরে মন না দিয়ে চলে না।
সোমশংকর তার কাছে বিনয়াবনত, সুষমার দেহমন ভক্তিতে আবিষ্ট। অন্য সকলে কীভাবে ওকে অভ্যর্থনা করবে স্থির করতে পারছে না, ভক্তি দেখাতেও সংকোচ, না দেখাতেও লজ্জা। দেহের দৈর্ঘ্য মাঝারি আয়তনের চেয়ে কিছু বড়ো, মনে হয় চারি দিকের সকলের থেকে পৃথক তার ঋজু সুদৃঢ় শরীর, যেন ওকে ঘিরে আছে একটা সূক্ষ্ণ ভৌতিক পরিবেষ্টন। ললাট অসামান্য উন্নত, জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ, ঠোঁটে রয়েছে অনুচ্চারিত অনুশাসন, মুখের রঙ পান্ডুর স্বচ্ছশ্যাম, অন্তর থেকে বিচ্ছুরিত দীপ্তিতে ধৌত।

দাড়িগোঁফ কামানো, সুডৌল মাথায় ছোটো করে ছাঁটা চুল, পায়ে নেই জুতো, তসরের ধুতিপরা, গায়ে খয়েরি রঙের ঢিলে জামা। নাম মুক্তারাম শর্মা; সকলেরই বিশ্বাস আসল নাম ওটা নয়। পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে ঈষৎ হেসে শান্ত হয়ে থাকে, তা নিয়ে কল্পনা করে নানা লোকে নানা প্রকার, কোনোটা অদ্ভুত অপ্রাকৃত, কোনোটা কুৎসায় কটু। ওর শিক্ষা য়ুরোপে এইরকম জনশ্রুতি- নিশ্চিত প্রমাণ নেই। কলেজের ছেলেরা অনেকে ওর কাছে আসে পড়া নেবার জন্যে, তাদের বিশ্বাস পরীক্ষায় উতরিয়ে দিতে ওর মতো কেউ নেই, অথচ কলেজি শিক্ষার ‘পরে ওর নিরতিশয় অবজ্ঞা।

এই শেখাবার উপলক্ষ করে ছেলেদের উপর ওর প্রভাব পড়ছে ছড়িয়ে। এমন একদল আছে যারা ওর জন্য প্রাণ দিতে পারে। এই ছেলেদের ভিতর থেকে বাছাই ক’রে ও একটি অন্তরঙ্গ চক্র তৈরি করেছে কি না কে জানে- হয়তো করেছে। ছুটির সময় একদলকে সঙ্গে নিয়ে ও ভ্রমণ করতে যায় দূর প্রদেশে, দেখা যায় সব জায়গাতেই ওর পরিচিত ভক্ত, তাদের ভাষাও ওর জানা।


সুষমা যখন প্রথম কলেজে প্রবেশ করেছে তখন মুক্তারামের কাছে ওর পাঠ আরম্ভ। বাঁধা পাঠ্য বইটাকে গৌণ করে শিক্ষক পড়িয়েছে আপন মত অনুসারে নানা বিষয়ের বই। ছুটির সময় যথাযোগ্য স্থানে নিয়ে গিয়ে ওকে ছুরি খেলতে, ঘোড়ায় চড়তে, ডিঙি নৌকো দুহাতে দাঁড় ধরে বাইতে করেছে পটু, মোটর গাড়ির কলের তত্ত্ব, চালানোর কৌশল নিপুণ করে শিখিয়েছে।


সুষমার বিধবা মা ব্রাহ্মসমাজের মেয়ে। এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান ব্রাহ্মমতে উপাসনা ক’রে হয় এই তার ছিল ইচ্ছে। সুষমা জিদ করে ধরে পড়ল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে মুক্তারামকে দিয়ে। মুক্তারামের কোন্‌ সম্প্রদায় কেউ জানে না, ব্রাহ্মসমাজে তার গতিবিধি নেই, আর অচরণ নয় নিষ্ঠাবান হিন্দুর মতো। সুষমার মা বিভাসিনী গভীর ভক্তি করে মুক্তারামকে, তবু তার ইচ্ছা ছিল সমাজের লোক দিয়েই ক্রিয়াটা নিষ্পন্ন হয়। সুষমা কোনোমতেই রাজী হল না। আজ মুক্তারামের আহ্বান এখানে সেই কারণেই।
মুক্তারামকে সবাই সংকোচ করে, বাঁশরি করে না। সে এসেই একটি ছোটরকম নমস্কার করে বললে, ‘সুষমার মাস্টরিতে আজ শেষ ইস্তফা দিতে এসেছেন?’
‘কেন দেব? আরো একটি ছাত্র বাড়ল।’


বাঁশরি সোমশংকরের দিকে তীব্র কটাক্ষ হেনে বললে, ‘তাকে মুগ্ধবোধের পাঠ শুরু করাবেন? ওই দেখুন- না, মুগ্ধতার তলায় ডুবেছে মানুষটা, হঠাৎ ওর বোধোদয় কোনোদিন হয় যদি সেদিন ডাক্তার ডাকতে হবে।’ মুক্তারাম কোনো উত্তর না করে বাঁশরির মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালে। নীরবে জানালে একে বলে ধৃষ্টতা। বাঁশরির মতো মেয়েও কুন্ঠিত হল এই দৃষ্টিপাতে।


স্বল্পজলা নদীর স্রোতঃপথ প্রশস্ত হয়ে এখানে- ওখানে চর পড়ে যেরকম দৃশ্যটা হয় সেইরকম চেহারা বিভাসিনীর। শিথিল প্রসারিত হয়েছে দেহ, কিছু মাংসবাহুল্য ঘটেছে তবু চাপা পড়ে নি যৌবনের ধারা। তার সৌন্দর্য স্বীকার করতে হয় আজও। পতিকুলে মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই তার, স্বামীর দত্ত সম্পত্তি থেকে সংসারের অভাব সহজেই পূরণ হয়ে আরো কিছু হাতে থাকে। কন্যার ভবিষ্যৎ লক্ষ করে সেই টাকা এতদিন সঞ্চিত হয়েছে বিশেষ যত্নে। সোমশংকরের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ প্রস্তাবের পর থেকে সেই দায়িত্বের টান এসেছে আলগা হয়ে।


এই বিবাহ যে হতে পারে এ ছিল অভাবনীয়। সবাই জানত রাজকুমার সম্পূর্ণ বাঁশরির প্রভাবের অধীনে, কেউ যে তার নাগাল পেতে পারে এ কথা মনে হত অসম্ভব। কিন্তু সেসময় বেঁচে ছিল পূর্বতন রাজা প্রভুশংকর, বাঁশরির সঙ্গে সোমশংকরের বিবাহের প্রধান বাধা। অল্পদিন হল পিতার মৃত্যু হয়েছে। তবু জাতের বাধা কাটতে চায় না। ক্ষত্রিয়বংশের বাইরে রাজার বিবাহ প্রস্তাবে প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এমন সময়ে মুক্তারাম এই সম্বন্ধ পাকা করলেন কী করে সেই এক কাহিনী।


বিভাসিনী এসে সংবাদ দিল, সময় উপস্থিত। ঘরের ভিতরে বেদি রচনা করে সভার স্থান হয়েছে। নিমন্ত্রিতেরা সবাই চলল সেইদিকে। বাঁশরির নিমন্ত্রণ হয় নি, তা ছাড়া কন্যাপক্ষের ইচ্ছে ছিল না সে উপস্থিত থাকে। বাঁশরি এসেছে ভদ্ররীতি এবং ভদ্রসমাজকে উপেক্ষা ক’রে। তার দৃঢ় পণ সে থাকবে অনুষ্ঠান- সভার মধ্যেই। কেউ- বা হাসবে, কেউ- বা রাগবে, কিন্তু কিসের কেয়ার করে সে। মনকে শক্ত করে মাথা তুলে পা বাড়াচ্ছিল ঘরের মধ্যে, পা গেল কেঁপে, বোধ করি চোখে আসছিল জল, পারলে না ঘরে যেতে, আটকে রইল বাইরে।
পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করলে, ‘ঘরে যাবে না?’
বাঁশরি বললে।’না, সস্তাদামের সদুপদেশ শুনলে গায়ে জ্বর আসে।’


‘সদুপদেশ!’
‘হাঁ, উপদেষ্টার শিকারের এই তো সময়, যাকে বলে সুবর্ণ সুযোগ। পায়ে দড়ি- বাঁধা জীবের ‘পরে নিঃশেষ করে দেয় শব্দভেদী বাণের তূণ, সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ পায় আহূত- রবাহূতের দল।’
‘আমি একবার দেখে আসি- না।’
‘না, শোনো, একটা প্রশ্ন আছে। সাহিত্য- সম্রাট, গল্পটার মজ্জা যেখানে সেখানে পৌঁচেছে তোমার দৃষ্টি?’
‘আমার হয়েছে অন্ধগোলাঙ্গুলন্যায়। লেজটা ধরেছি চেপে বাকিটা টান মেরেছে আমাকে, সমস্ত চেহারাটা পাচ্ছি নে। মোট কথাটা বুঝছি সুষমা বিয়ে করবে রাজাবাহাদুরকে, পাবে ঐশ্বর্য, তার বদলে হাতটা দিতে প্রস্তুত হৃদয়টা নয়।’


‘শোনো, বলি, সোমশংকর নয় প্রধান নায়ক এ কথা মনে রেখো।’
‘তাই না কি। তা হলে অন্তত গল্পের ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দাও, তার পরে সাঁতরে হোক খেয়া ধরে হোক পারে পৌঁছব।’
‘এ খবরটা বোধহয় আগে থাকতেই জান, যে, মুক্তারাম তরুণসমাজে বিনামাইনের মাস্টারি করে থাকেন, বাছাই করে নেন ছাত্র। ছাত্রী পেতে পারতেন অসংখ্য- কিন্তু তাদের সম্বন্ধে বাছাই করার রীতি এত কড়া যে এতদিনে একটিমাত্র পেয়েছেন, তারই নাম সুষমা সেন।’
‘যাদের ত্যাগ করেছেন তাদের কী দশা!’


‘তাদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা কত, খবর পাই নি। কিন্তু এ জানি, তাদের অনেকেই চক্ষু মেলে চাঁদের পানে তাকিয়ে থাকে।’
‘সেই চকোরীর দলে তুমি নাম লেখাও নি বাঁশি?’
‘তোমার কী মনে হয়?’
‘আমার মনে হয় চকোরী নও, তুমি মিসেস রাহুর পদ পাবার উমেদার। তুমি যাকে নেবে তাকে আগাগোড়া দেবে আত্মসাৎ করে, চক্ষু মেলে চেয়ে থাকা নয়।’
‘ধন্য!’সাধু’, চরিত্রচিত্রে তুমি হবে বাংলাদেশে প্রথমশ্রেণীর প্রথম। গোল্ডমেডালিস্ট। লোকমুখে শোনা যায় মেয়েদের স্বভাবের রহস্য ভেদ করতে হার মানেন মেয়েদের সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত- তোমার দৃষ্টি দেখছি কোনো বাধা মানে না।’


হাতজোর করে পৃথ্বীশ- বললে, ‘বন্দনা সারা হল, এবার পালা শুরু করো।’
‘এটা কি এখনো আন্দাজ করতে পার নি যে, সুষমা ওই মুক্তারাম সন্ন্যাসীর ভালোবাসায় একেবারে শেষ পর্যন্ত তলিয়ে গিয়েছে।’
‘ভালোবাসা না ভক্তি?’
‘চরিত্রবিশারদ, এখনো জান না, মেয়েদের যে ভালোবাসা ভক্তিতে পৌঁছয় সেটা তাদের মহাপ্রয়াণ। তার থেকে ফেরবার রাস্তা নেই। মেয়েদের মায়ায় অভিভূত হয়ে সমানক্ষেত্রে যারা ধরা দিয়েছে তারা কেনে ইন্টারমিডিয়েটের টিকিট, কেউ- বা থার্ডক্লাসের। মেয়েদের কাছে হার মানল না যে, ওদের ভুজপাশের দিগ্‌বলয় এড়িয়ে যে উঠল মধ্য গগনে, দুই জোড়হাত উপরে তুলে তাকেই দিলে মেয়েরা আপন শ্রেষ্ঠদান। দেখ নি কী সন্ন্যাসী যেখানে সেখানে মেয়েদের কী ভিড়।’


‘আচ্ছা, মানছি তা, কিন্তু উল্টোটাও দেখেছি। মেয়েদের বিষম টান বর্বরের দিকে, তাদের কঠোরতম অপমানে ওরা পুলকিত হয়ে ওঠে, পিছন পিছন রসাতল পর্যন্ত যেতে হয় রাজি।’
‘তার কারণ মেয়েরা অভিসারিকার জাত, এগিয়ে গিয়ে যাকে চাইতে হয় তার দিকেই ওদের ভালোবাসা। উপেক্ষা তারই ‘পরে দুর্বৃত্ত হবার মতো জোর নেই যার কিংবা দুর্লভ হবার মতো তপস্যা।’
‘বুঝলুম, ওই সন্ন্যাসীকে ভালোবেসেছে সুষমা।’


‘কী ভালোবাসা। মরণের বাড়া। কোনো সংকোচ ছিল না। কেননা ঠাউরেছিল একেই বলে ভক্তি। মাঝে মাঝে মুক্তারামকে দূরে যেতে হত কাজে, তখন সুষমা শুকিয়ে যেত, মুখ হয়ে যেত ফ্যাকাসে, চোখে প্রকাশ পেত জ্বালা, মন শূন্যে শূন্যে খুঁজে বেড়াত কার দর্শন, পড়াশুনোতে মন দেওয়া হত অসম্ভব। বিষম ভাবনা হল মায়ের মনে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঁশি, কী করি।’ আমার বুদ্ধির উপর বিশ্বাস ছিল তখনো। আমি বললেম, ‘মুক্তারামের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দাও।’ শুনে আঁৎকে উঠে বললেন, ‘এমন কথা ভাবতে পার কী করে।’ তর্ক না করে নিজেই চলে গেলুম মুক্তারামের কাছে। সোজা বললেম, ‘নিশ্চয় জানেন, সুষমা আপনাকে অসম্ভবরকম ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করে উদ্ধার করুন বিপদ থেকে।’

এমন করে তাকালেন মুখের দিকে, আমার রক্তচলাচল গেল থেমে। গম্ভীর সুরে বললেন, ‘সুষমা আমার ছাত্রী, তার ভার আমার উপরে, তা ছাড়া আমার ভার তোমার উপরে নেই।’ পুরুষের কাছে এত বড়ো ধাক্কা আমার জীবনে এই প্রথম। ধারণা ছিল সব পুরুষের ‘পরেই সব মেয়ের আবদার চলে যদি সাহস থাকে আবদার করবার। দেখলেম দুর্ভেদ্য দুর্গ আছে, মেয়েদের সাংঘাতিক বিপদ সেই রুদ্ধদ্বারের সামনে। এর পরের অধ্যায়ের বিবরণ পাওয়া যায় একখানা চিঠি থেকে, তার কপি দেখাব তোমার শিক্ষার্থে।’


এমন সময়ে যে- ঘরে সভা বসেছিল সেখানে কোন্‌ এক জানলা থেকে অপরাহ্ন- সূর্যের রশ্মি বাঁকা হয়ে পড়ল ঠিক সুষমার মুখে। দূর থেকে বাঁশরি দেখতে পেলে উপদেশের এক অংশে মুক্তারাম বর- কনের পরস্পরের আঙটিবদল উপলক্ষে সুষমার আঙুল থেকে আঙটি খুলে নিয়ে সোমশংকরের আঙুলে পরাচ্ছে। সুষমা পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ, শান্ত তার মুখ, দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর [করে] পড়ছে জল।
বাঁশরি বললে, ‘মুক্তারামের মুখখানা একবার দেখো। ওই যে সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেমন লক্ষ যোজন মাইল দূরে, ওই মেয়েটার মনে যে অগ্নিকান্ড চলছে তার সঙ্গে সম্পর্ক নেই অথচ তাকে নিয়ে উজ্জ্বল ছবি বানিয়ে তুললে, মুক্তরামও নিজের মধ্যে যে তত্ত্বটা নিয়ে আছে সে ওই মেয়েটার মর্মান্তিক বেদনা থেকে বহুদূরে, তবু নিষ্ঠুর রেখায় ফুটিয়ে তুললে নাটকটাকে।’


পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করলে, ‘সুষমার প্রতি সন্ন্যাসীর মন সত্যিই এতই যদি নির্লিপ্ত হবে ওকে অমন করে বেছে নিলে কেন?’
‘আইডিয়ালিস্ট! বাস্‌ রে ওদের মতো ভয়ংকর নির্মম জীব নেই জগতে। আফ্রিকার অসভ্য মারে মানুষকে নিজে খাবে বলে। এরা মারে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায়, নিজে খায় না ক্ষিধে পেলেও, সারে সারে নরবলি দেয় আইডিয়ার কাছে। জেঙ্গিস খাঁর চেয়ে সর্বনেশে।’
‘বাঁশি, সন্ন্যাসীর ‘পরে তোমার মনোভাবে কোনো রস দেখছি না তো। করুণা নয়, ভক্তি তো নয়ই।’
‘ভক্তি করবার মেয়ে নই গো আমি! মেয়েদের পরমশত্রু ওই মানুষটা। রাজরানী যদি হতুম মেয়েদের চুলে দড়ি পাকিয়ে ওকে দিতুম ফাঁসি। কামিনীকাঞ্চন ও ছোঁয় না তা নয় কিন্তু তাকে দেয় ফেলে ওর কোন্‌ এক জগন্নাথের রথের তলায়, বুকের পাঁজর যায় গুঁড়িয়ে।’


‘ওর আইডিয়াটা কী জানা চাই তো।’
‘সন্ধান পাওয়া শক্ত। ওর এক শিষ্যকে জানি, তার রস সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নি, ডাক দিলে খুশি হয়ে আসে কাছে। সেই মুগ্ধের মুখ থেকে খবর আদায় করেছিলুম।’তরুণ তাপস সংঘ’ নামে মুক্তারাম এক সংঘ বানিয়েছে। বাছা বাছা ছেলেদের পুরোপুরি মানুষ করে তোলবার ব্রত ওর। তার পরে বীজবপনের নিয়মে সমস্ত ভারতবর্ষময় দেবে তাদের ছড়িয়ে।’
‘কিন্তু তরুণী?’
‘একেবারে বিবর্জিতা।’
‘তা হলে সুষমাকে কিসের প্রয়োজন?’


‘অন্ন চাই যে। ব্রহ্মচারীকেও ভিক্ষার জন্য আসতে হয় মেয়েদের দ্বারে। রাজভান্ডারের চাবি দিতে চান ওর হাতে। রোসো অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে আসছে, এইবার ঘরে ঢুকে দেখে আসি গে।’
গেল ঘরের মধ্যে। তখন মুক্তারাম বলছে, ‘তোমরা যে সম্বন্ধ স্বীকার করছ, জেনো, সে আত্মপ্রকাশের জন্যে, আত্মবিলোপের জন্যে নয়। যে- সম্বন্ধ মুক্তির দিকে নিয়ে চলে তাকেই শ্রদ্ধা করি, যা বেঁধে রাখে পশুর মতো তা প্রকৃতির হাতে গড়া প্রবৃত্তির শিকলই হোক আর মানুষের কারখানায় গড়া দাসত্বের শিকলই হোক- ধিক্‌ তাকে।’


উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুষমার মুখ, যেন সে দৈববাণী শুনলে। মুক্তারামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।
চৌরঙ্গি অঞ্চলে বাঁশরিদের বাড়ি। সেখানে ওর দুই অবিবাহিত ভাই থাকে। পাটনা অঞ্চলে থাকতে হয় বাপকে বেহার গবর্মেন্টের কোন্‌ কাজে। মা প্রায়ই থাকে তারই সঙ্গে, মেয়েকে রাখতে চায় কাছে, মেয়ে কলকাতা ছেড়ে যেতে নারাজ।

পৃথ্বীশকে বাঁশরি এত প্রশ্রয় দেয়, সেটা একেবারেই পছন্দ করে না ভাইরা। সবাই জানে বাঁশরির বুদ্ধি অসামান্য তীক্ষ্ণ, মেয়েদের দিক থেকে সেটা একেবারেই আরামের নয়, তা ছাড়া ওর অধিকাংশ সংকল্প দুঃসাহসিক হিংস্র প্রাণীর মতো, শুধু যে লম্বা লাফ দিতে পারে তা নয়, সঙ্গে থাকে প্রচ্ছন্ন কোষে তীক্ষ্ণ নখর। ওর ভাইরা সুযোগ পেলেই পৃথ্বীশের চেহারা নিয়ে, লেখা নিয়ে ঠাট্টা করে, কিন্তু এ বাড়িতে যাতায়াতের বাধা দেবার অভাসমাত্র দিতে সাহস পায় না।


পৃথ্বীশ জানে এদের ঘরে তার প্রবেশ অনভিলষিত। তাই নিয়ে ওখানকার দ্বারী থেকে আরম্ভ করে সমস্ত পুরুষ অধিবাসীর কাছে ওর সংকোচ ভাঙতে চায় না- ও কেবলই মনে করে, ওর আদ্যোপান্ত সমালোচনা করে সবাই, বিশেষত কপালের সেই দাগটার। এদের বাড়িতে অন্য যে- সব অভ্যাগতদের আসতে দেখে, তারা সাজে সজ্জায় ভাবে ভঙ্গিতে ওর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শ্রেণীর মানুষ। ও চেষ্টা করে নিজেকে বোঝাতে যে ওরা ডেকোরেটেড ফুল্‌স্‌, কিন্তু সেই স্বগতোক্তিতে লজ্জা চাপা পড়ে না। ও যখন দেখে অন্যরা এখানে আসে স্বাধিকারের নিঃসংকোচে তখন আপন সাহিত্যিক আভিজাত্যবোধকে মনে মনে সবলে স্ফীত করে তুলেও নিজেকে ওদের সমান বহরে দাঁড় করাতে পারে না। সেটা বোঝে বাঁশরি এবং এও বোঝে যে বাঁশরির দিকে ওর আকর্ষণ প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে অন্তত তার একটা কারণ এই শ্রেণীগত দুরধিগম্যতা।

বাঁশরির সামীপ্যে ওর মনে একটা অহংকার জাগে, ইচ্ছে করে দেখুক সব বাইরের লোকে। এই অহংকারটা ওর পক্ষে লজ্জার কারণ। তা জেনেও পারে না সামলাতে। একটা কথা বুঝে নিয়েছে বাঁশরি যে, ওদের বাড়িতে হেঁটে আসতে বাধে পৃথ্বীশের। যখন দরকার হয় নিজের গাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওকে আনতে। অর্থাভাবগ্রস্ত পৃথ্বীশ শোফারকে মোটা বকশিস দিতে ভোলে না।


আজ শৌখিনমন্ডলীর দিনারম্ভে অর্থাৎ বেলা আটটায় গাড়ি পাঠিয়েছিল বাঁশরি। সেদিন পৃথ্বীশের হল অকালবোধন। তারও দিনগণনা হয় পূর্বাহ্নের প্রথম ক’টা ঘন্টা বাদ দিয়ে। বাঁশরির ভাইরা তখন বিছানায় শুয়ে আধ- মেলা চোখে চা খাচ্ছে। সূর্যের যেমন অরুণ সারথি, ওদের জাগরণের তেমনি অগ্রদূত গরম চায়ের পেয়লা। পৃথ্বীশ যখন এল বাঁশরির চুলবাঁধা তখন শিথিল, মুখ ফ্যাকাসে, আটপৌরে শাড়ি, পায়ে ঘাসের জাপানি চটি। মুগ্ধ হল পৃথ্বীশের মন, অসজ্জিত রূপের মধ্যে অন্তরঙ্গতা আছে, তাতে দুরু দুরু কাঁপিয়ে দিল ওর বুকের ভিতরটা। ইচ্ছে করতে লাগল মরীয়া হয়ে দুঃসাহসিক কথা একটা কিছু বলে ফেলে। মুখে বেধে গেল, শুধু বললে, ‘বাঁশি, আজ তোমাকে দেখাচ্ছে সকালবেলাকার অলস চাঁদের মতো।’


বাঁশরির স্পষ্ট করে বলতে ইচ্ছে করছিল ‘অকরুণ বিধাতার শাপ তোমার মুখে। মুগ্ধ দৃষ্টি তোমাকে মানায় না। দোহাই তোমার, গদগদ ভাবটা রেখে দিয়ো আপন নির্জন ঘরের বিরহের জন্য জমিয়ে।’ পৃথ্বীশের মুখের ‘পর চোখ রাখা বাঁশরির পক্ষে অনেক সময় অসম্ভব, বিশেষত যখন সেই মুখে কোনো আবেগের তরঙ্গ খেলে, হয় দুর্নিবার হাসি পায়, নয় ওকে পীড়িত করে।
পৃথ্বীশের ভাবোচ্ছাস থামিয়ে দিয়ে বাঁশরি বললে, ‘কাজের কথার জন্যে ডেকেছি, অন্য অবান্তর কথার প্রবেশ স্ট্রিক্টলি প্রোহিবিটেড।’
পৃথ্বীশ ক্ষুণ্ন হয়ে বললে, ‘জরুরি কথা এত কী আছে।’


‘জরুরি নয়! এই বুঝি তুমি আর্টিস্ট। নিজের চক্ষে দেখলে আসন্ন ট্র্যাজেডির প্রলয় সংকেত।
এখনো রঙের তুলি বাগিয়ে ধরতে মন ছট্‌ফট্‌ করছে না? আমার তো কাল সারারাত ঘুম হল না। কী বলব, বিধাতা শক্তি দেন নি নইলে এমন কিছু বলতুম যার অক্ষরে অক্ষরে উঠত আগুনের ফোয়ারা। আর্টিস্টের মতো দেখতে পাচ্ছি সমস্তটাই স্পষ্ট, অথচ আর্টিস্টের মতো বলতে পারছি না স্পষ্ট করে। চতুর্মুখ যদি বোবা হতেন তা হলে অসৃষ্ট বিশ্বের ব্যাথায় মহাকাশের বুক যেত ফেটে।’


‘বাঁশি, কে বলে তুমি প্রকাশ করতে পার না? কে বলে তুমি নও পুরো আর্টিস্ট? তোমার শক্তির যে- সব প্রমাণ মুখে- মুখে যেখানে- সেখানে হরির লুটের মতো ছড়িয়ে ফেলো দেখে আমার ঈর্ষা হয়।’
‘আমি যে মেয়ে, আমার প্রকাশ ব্যক্তিগত। বলবার লোক স্পষ্ট সামনে পেলে তবেই বলতে পারি। কেউ নেই অথচ বলা আছে এইটে পুরুষ আর্টিস্টের। সেই বলা চিরকালের- আমাদের বলা যত হোক সে কেবল নগদ বিদায় দিনদিনের। ঘরে ঘরে মুহূর্তে মুহূর্তে সে বুদ্‌বুদের মতো উঠছে আর মেলাচ্ছে।’
পুরুষ আর্টিস্টের অহংকার ঘনিয়ে উঠল, সে বললে, ‘আচ্ছা বেশ, কাজ শুরু হোক। কাল বলেছিলে একটা চিঠির কথা।’


‘এই নাও, ‘ ব’লে একটা চিঠির কপি করা এক অংশ ওকে পড়তে দিলে। তাতে আছে- ‘প্রেমে মানুষের মুক্তি। কবিরা যাকে ভালোবাসা বলে সেটা বন্ধন। তাতে একজন মানুষকে আসক্তির দ্বারা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তাকেই তীব্র স্বাতন্ত্র্যে অতিকৃত করে তোলে। যত তার দাম প্রকৃতিজুয়ারি তার চেয়ে অনেক বেশি ঠকিয়ে আদায় করে। এই তো প্রকৃতির চাতুরি, নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। মোহের জাদু লাগিয়ে এই মরীচিকার সৃষ্টি। এই কথাটাকেই শেক্সপিয়ার কৌতুকচ্ছলে দেখিয়েছেন তাঁর ভরাবসন্তের স্বপ্নে। প্রেম জাগ্রত দৃষ্টি, নরনারীর ভালোবাসা স্বপ্নদৃষ্টি নেশার ঘোরে। প্রকৃতি মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে অনুভূতিকে তীব্র করে, তাকে সহজ সত্যবোধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয়।

এই ভোলানোটা প্রকৃতির স্বরচিত। খাঁচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশায় বশ করা যায়। বন্ধনের প্রতি আসক্তিকে সর্বান্তঃকরণে ভয় করো, জেনো ওটা সত্য নয়। সংসারে যত দুঃখ, যত বিরোধ সকলের মূল এই ভ্রান্তি নিয়ে, যে ভ্রান্তি শিকলকে মূল্যবান করে দেখায়। কোন্‌টা সত্য কোন্‌টা মিথ্যে যদি চিনতে চাও, তবে বিচার করলেই বুঝতে পারবে কোন্‌টাতে মুক্তি দেয়, কোন্‌টাতে দেয় না। প্রেমে মুক্তি, আসক্তিতে বন্ধন।’


‘চিঠি পড়লুম। তার পরে?’ ‘তারপরে তোমার মাথা, অর্থাৎ কল্পনা। মনে মনে শুনতে পাচ্ছ না, শিষ্যকে বলছেন সন্ন্যাসী- ভালোবাসা আমাকেও না, ভালোবাসা আর কাউকেও না। নির্বিশেষ প্রেম, নির্বিকার আনন্দ, নিরাপদ আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র।’
‘তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে?’


সেই রাস্তাই তো তৈরি হল প্রেমে। সন্ন্যাসী বলেছেন প্রেমে সকলেরই অধিকার। সোমশংকরের তাতে পেট ভরবে না, সে চেয়েছিল বিশেষ প্রেম, মীনলাঞ্ছনের মার্কা মারা। কিন্তু সর্বনাশে সমুৎপন্নে যথালাভ, অর্ধেকের চেয়ে কম হলেও চলে। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, সুষমা ওকে খুব গম্ভীর সুরে বলেছিল, যে- প্রেম বিশ্বের সকলের জন্যে আমাদের দুজনের মিলন সেই প্রেমের পথকেই খুলে দেবে। পথের মাঝখানটা ঘিরে নিয়ে দেয়াল তুলবে না। শুনে সোমশংকরের ভালোবাসা দ্বিগুণ প্রবল হয়েছে। সেই ভালোবাসা নির্বিশেষ প্রেম নয় এ কথা লিখে রাখতে পারো।’
‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, এ অবস্থায় তুমি হলে কী করতে।’


‘আমি হলে পরম ভক্তিভরে সন্ন্যাসীর কথা সোনার জলে মরক্কো চামড়ার বাঁধা খাতায় লিখে রাখতুম, তার পরে দুর্দম আসক্তির জোর কলমে তার প্রত্যেক অক্ষরের উপর দিতাম কালির আঁচড় কেটে। ওই তাপস চায় প্রকৃতির মতোই মুগ্ধ করতে, নিজের মন্ত্র দিয়ে অন্যের মন্ত্রটা খন্ডন করবার জন্যে। আমার উপর খাটত না এ মন্ত্র, যদি একটু সম্ভব হত তা হলে সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে সুষমার দিকে তাকাত না, এ কথা আমি জোর করেই বলতে পারি।’
‘বেশ কথা, কিন্তু ইতিহাসের গোড়ার দিকে আনেকটা ফাঁক পড়েছে, সেটা ভরিয়ে নিতে হবে। ওদের বিবাহসম্বন্ধ সন্ন্যাসী ঘটালো কী উপায়ে?’


‘প্রথমত সেনবংশ যে ক্ষত্রিয়, তারা যে কোনো- এক খৃস্টশতাব্দীতে দক্ষিণ থেকে এসেছিল দিগ্‌বিজয় বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশে, সেইটে প্রমাণ করে হিন্দি অনুবাদসহ সংস্কৃততে লিখলে এক পুঁথি। কাশীর কোনো কোনো দ্রাবিড়ী পন্ডিতের সমর্থন জুড়ে দিলে তার সঙ্গে। সন্ন্যাসী স্বয়ং সোমশংকরের রাজ্যে গেল- প্রজারা চেহারা দেখেই তেত্রিশ কোটির মধ্যে কোন্‌- এক দেবতার অংশাবতার বলে নিলে ওকে মাথায় করে। সভাপন্ডিত শুদ্ধ মুগ্ধ হল আলাপে। কুমায়ুনের কোন্‌ পাহাড়ে এদের দুজনের ঘটালে সাক্ষাৎ। ওরা দোঁহে মিলে ঘোড়ায় চড়ে ফিরল দুর্গমে, শিকারে বেরোল বনে জঙ্গলে। বীরপুরুষের মন ভুলল অনেকখানি প্রকৃতির মোহে, অনেকখানি সন্ন্যাসীর মন্ত্রে, তার পর এই যা দেখছ।’


‘ইচ্ছা করছে তরুণ তাপস সংঘে আমিও যোগ দিই।’
‘কেন, সংসারতাপ নিবারণের জন্যে, না পেটের জ্বালা?’
‘সন্ন্যাসীর Love’s philoshphy যা শুনলুম শেলির সঙ্গে তা মেলে না কিন্তু মনের শান্তি পাবার জন্যে নিজের পক্ষে আশু তার প্রয়োজন।’
‘যেয়ো সংঘে, কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু তার আগে এমন একটা গল্প লিখে যাও যাকে নাম দিতে পারবে মোহমুদ্‌গর।’
‘শংকরের মোহমুদ্‌গর?’
‘হাঁ তাই। সত্য কথা লিখতে শেখো। ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে নয়, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে।’


বাঁশরির মুখ লাল হয়ে উঠেছে, দৃষ্টিতে জ্বলছে যেন ইস্পাতের ঝল্‌সানি। পৃথ্বীশ মনে মনে ভাবছে- কী সুন্দর দেখাচ্ছে এ’কে।
বাঁশরি একসময়ে চৌকি থেকে উঠে বললে, ‘বলবার কথা শেষ হল। এখন মফিজকে বলে আসি তোমার জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসুক।’
পৃথ্বীশ ছুটে এসে ওর হাত চেপে ধরলে, বললে, ‘খাবার চাই নে, তুমি যেয়ো না।’
বাঁশরি হাত ছুটিয়ে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। বললে, ‘আমাকে হঠাৎ তোমার ‘বেমানান’ গল্পের নায়িকা বানিয়ে তুলো না, তোমার জানা উচিত ছিল আমি ভয়ংকর সত্যি।’
ঠিক সেই সময়ে ড্রেসিং গাউন প’রে ওর ভাই সতীশ ঢুকে পড়ল ঘরে। জিজ্ঞাসা করলে, ‘উচ্চ হাসির আওয়াজ শুনলাম যে।’


‘উনি এতক্ষণ স্টেজের মনুবাবুর নকল করছিলেন। ভারি মজা।’
‘পৃথ্বীশবাবুর নকল আসে নাকি?’
‘ওঁর বই পড়লেই তো টের পাওয়া যায়। শোনো, ওর জন্যে মফিজকে কিছু খাবার আনতে বলে দাও তো।’
পৃথ্বীশ বললে, ‘না দরকার নেই, কাজ আছে, দেরি করতে পরব না।’ ব’লে দ্রুত নমস্কার ক’রে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাঁশরি পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললে, ‘মনে থাকে যেন আজ বিকেলে সিনেমা আছে। তোমারই সেই পদ্মাবতী।’ উত্তর এল, ‘সময় হবে না।’
বাঁশরি মনে মনে বললে, সময় হবেই জানি। অন্যদিনের চেয়ে দু ঘন্টা আগে।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে, ‘আচ্ছা তুমি ওই পৃথ্বীশের মধ্যে কী দেখতে পাও বলো দেখি।’
‘ওর বিধাতা ওকে যে পরীক্ষার কাগজ দিয়েছিলেন দেখতে পাই তার উত্তর। আর তার মাঝখানটাতে দেখি পরীক্ষকের কাটা দাগ।’


‘এমন ফেল- করা জিনিস নিয়ে করবে কী?’
‘ওকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করাব।’
‘তার পরে স্বহস্তে প্রাইজ দেবে নাকি?’
‘সর্বনাশ, দিলে জীবের প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হবে।’
কথা ছিল বর- কনের পরস্পর আলাপ জমাবার অবসর দেওয়া চাই, তাই বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরো দু মাস। কিন্তু সেদিন বাঁশরির অনিমন্ত্রিত প্রবেশ দেখে কন্যাপক্ষ সকলে ভয় পেয়ে গেল। বুঝল যে দুর্গ আক্রমণ শুরু হল। সন্ন্যাসীর গাঁথা দেয়াল যদি কোনো মেয়ে টলাতে পারে, সে একা বাঁশরি।


দিন- পনেরোর মধ্যে বিয়ে স্থির হল। বাইরে বাঁশরির উচ্চহাসি উচ্চতর হতে লাগল, কিন্তু ভিতরে যদি কারো দৃষ্টি পৌঁছত দেখতে পেত পিঁজরের মধ্যে সিংহিনী ঘুরছে ল্যাজ আছড়িয়ে। বেলা দশটা হবে, সোমশংকর বসে আছে বারান্দায়, সামনে মেঝের উপর বসেছে জহরী নানা- প্রকার গয়নার বাক্স খুলে, রেশমি ও পশমি কাপড়ের গাঁঠরি নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছে কাশ্মীরি দোকানদার, এমন সময় কোনো খবর না দিয়েই এসে উপস্থিত বাঁশরি। বললে, ‘ঘরে চলো।’ দুজনে গেল বৈঠকখানায়। সোফায় বসল সোমশংকর, বাঁশরি বসল পাশেই।


বললে, ভয় নেই, কান্নাকাটি করতে আসি নি। তা হোক তবু তোমার ভাবনা ভাববার অধিকার আমাকে দিয়েছ, তাই একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, জান কি তুমি, যে সুষমা তোমাকে ভালোবাসে না।’
‘জানি।’
‘তাতে তোমার কিছুই যায় আসে না।’
‘কিছুই না।’
‘তা হলে সংসারযাত্রাটা কীরকম হবে?
‘সংসারযাত্রার কথা ভাবছি নে।’
‘তবে কিসের কথা ভাবছ।’
‘ভাবছি একমাত্র সুষমার কথা।’


‘অর্থাৎ তোমাকে ভালো না বেসেও কী করে ও সুখী হবে?’
‘সুষমার মতো মেয়ের সুখী হবার জন্যে ভালোবাসার দরকার নেই।’
‘কিসের দরকার আছে, টাকার?’
‘এটা তোমার যোগ্য কথা হল না বাঁশরি- এটা যদি বলত কলুটোলার ঘোষগিন্নি আশ্চর্য হতুম না।’
‘আচ্ছা, ভুল করেছি। কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর বাকি আছে। কিসের দরকার আছে সুষমার।’
‘জীবনে ও একটা কোন্‌ লক্ষ্য ধরেছে, সেইটে ওর ধর্ম। সাধ্যমতো আমি যদি কিছু পরিমাণে তাকে সার্থক করতে পারি তা হলেই হল।’
‘লক্ষ্যটা কী বোধহয় জান না।’
‘জানবার চেষ্টাও করি নি। যদি অপনা হতে ইচ্ছে ক’রে বলে জানতে পাব।’
‘অর্থাৎ ওর লক্ষ্য তুমি নও, তোমার লক্ষ্য ওই মেয়ে।’
‘তাই বলতে পারি।’


‘এ তো পুরুষের মতো শোনাচ্ছে না, ক্ষত্রিয়ের মতো নয়ই।’
‘আমার পৌরুষ দিয়ে ওর জীবন সম্পূর্ণ করব, ওর ব্রত সার্থক করব- আর কিছু চাই নে আমি। আমার শক্তিকে ওর প্রয়োজন আছে এই জেনে আমি খুশি। সেই কারণে সকলের মধ্যে আমাকেই ও বেছে নিয়েছে এই আমার গৌরব।’
‘এতবড়ো পুরুষকে মন্ত্র পড়িয়েছে সন্ন্যাসী। বুদ্ধিকে ঘোলা করেছে, দৃষ্টিকে দিয়েছে চাপা। শুনলুম ভালো হল আমার, শ্রদ্ধা গেল ভেঙে; বন্ধন গেল ছিঁড়ে। শিশুকে মানুষ করার কাজ আমার নয়, সে কাজের ভার সম্পুর্ণ দিলুম এই মেয়েকে।’


এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল মুক্তারাম। পদধূলি নিয়ে তাকে প্রণাম করলে সোমশংকর।
অগ্নিশিখার মতো বাঁশরি দাঁড়াল তার সামনে। বললে, ‘আজ রাগ করবেন না। ধৈর্য ধরবেন, কিছু বলব, কিছু প্রশ্ন করব।’
‘আচ্ছা বলো তুমি।’- মুক্তারামের ইঙ্গিতে সোমশংকর চলে গেল।
‘জিজ্ঞাসা করি, সোমশংকরকে শ্রদ্ধা করেন আপনি।’
‘বিশেষ শ্রদ্ধা করি।’
‘তবে কেন এমন মেয়ের ভার দিচ্ছেন ওর কাঁধে যে ওকে ভালোবাসে না।’
‘যে ভার দিয়েছি আমি তাকেই বলি মহদ্‌ভাব। বলি পুরস্কার। একমাত্র সোমশংকর সুষমাকে গ্রহণ করবার যোগ্য।’


‘ওর চিরজীবনের সুখ নষ্ট করতে চান আপনি?’
‘সুখকে উপেক্ষা করতে পারে ওই বীর মনের আনন্দে।’
‘আপনি মানবপ্রকৃতিকে মানেন না?’
‘মানবপ্রকৃতিকেই মানি, তার চেয়ে নীচের প্রকৃতিকে নয়।’
‘এতই যদি হল- বিবাহ ওরা নাই করত।’
‘ব্রতের সঙ্গে ব্রতকে প্রাণের বন্ধনে যুক্ত করতে চেয়েছিলুম। খুঁজছিলুম তেমন দুটি মানুষকে, দৈবাৎ পেয়েছি। এটা একটা সৃষ্টি হল।’
আর কেউ হলে বাঁশরি জিজ্ঞাসা করত- ‘আপনি নিজেই করলেন না কেন?’ কিন্তু মুক্তারামের চোখের সামনে এ প্রশ্ন বেধে গেল।


বললে, ‘পুরুষ বলেই বুঝতে পারছেন না, ভালোবাসা নইলে দুজন মানুষকে সম্পুর্ণ করে মেলানো যায় না।’
‘মেয়ে বলেই বুঝতে চাইছ না যে, প্রেমের মিলন ভালোবাসার চেয়ে সত্য, তাতে মোহের মিশেল নেই।’
‘সন্ন্যাসী, তুমি জান না মানুষকে। তার হৃদয়গ্রন্থি জোর করে টেনে ছিঁড়ে সেই জায়গায় তোমার নিজের আইডিয়ার গ্রন্থি জুড়ে দিয়ে অসহ্য ব্যাথার ‘পরে বড়ো বড়ো বিশেষণ চাপা দিতে চাও। গ্রন্থি টিকবে না।

ব্যাথাই যাবে থেকে। মানুষের লোকালয়ে তোমরা এলে কী করতে- যাও- না তোমাদের গুহার গহ্বরে বদরিকাশ্রমে- সেখানে মনের সাধে নিজেদের শুকিয়ে মারতে চাও মারো, আমরা সামান্য মানুষ আমাদের তৃষ্ণার জল মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মরুভুমিতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সাধনা বলে প্রচার করতে এলে কোন্‌ করুণায়? আমাদের অভিশাপ লাগবে না তোমাকে? যা তুমি নিজে ভোগ করতে জান না তা তুমি ভোগ করতে দেবে না ক্ষুধিতকে?


‘এই যে সুষমা, শোনো বলি, মেয়েরা চিতার আগুনে মরেছে অনেকে, ভেবেছে তাতেই পরমার্থ। তেমনি করে দিনে দিনে মরতে চাও জ্বলে- চাও না তুমি ভালোবাসা। কিন্তু যে চায়, পাষাণ করে নি যে আপন নারীর প্রাণ, কেন কেড়ে নিতে এলে তার চিরজীবনের সুখ। এই আমি আজ বলে দিলুম তোমাকে, ঘোড়ায় চড়ো, শিকার করো যাই কর, তুমি পুরুষ নও, আইডিয়ার সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধে তোমার দিন কাটবে না গো, তোমার রাত বিছিয়ে দেবে কাঁটার শয়ন।’
বাঁশরির উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে বাইরে থেকে তাড়াতাড়ি এল সোমশংকর। বললে, ‘বাঁশি, শান্ত হও, চলো এখান থেকে।’


‘যাব না তো কী। মনে কোরো না বুক ফেটে মরব, জীবন হয়ে থাকবে চির- চিতানলের শ্মশান। কখনো আমার এমন বিচলিত দশা হয় নি- আজ কেন বন্যার মতো এল এই পাগলামি! লজ্জা, লজ্জা, লজ্জা- তোমাদের তিনজনের সামনেই এই অপমান। মুছে ফেলব লজ্জা, এর চিহ্ন থাকবে না। চললুম।’
সন্ধেবেলায় কোনো একটা উপলক্ষে সানাই বাজছে সুষমাদের বাড়িতে। বাঁশরি তখন তার একলা বাড়ির কোণের ঘরে বসে পড়ছে একটা খাতা নিয়ে। শেষ হয়ে গেছে পৃথ্বীশের লেখা গল্প। নাম তার, ‘ভালোবাসার নীলাম’।


নায়িকা পঙ্কজা কেমন করে অর্থলোভে দিনে দিনে সার চন্দ্রশেখরের মন ভুলিয়ে তাকে আয়ত্ত করলে তার খুব একটা টকটকে ছবি, সুনিপুণ তন্নতন্ন তার বিবরণ। দুই নম্বরের নায়িকা দীপিকা নির্বোধকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, শেষকালে কী অসহ্য ঘৃণা, কী বুকফাটা কান্না। ছুটে বেরোলে আত্মহত্যা করতে, শীতকালে জলে পা দিতে গিয়েই হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে শীত করে উঠল, কিংবা হঠাৎ মনে সংকল্প এল বেঁচে থেকেই শেষ পর্যন্ত ওদের দুজনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। দ্বিধার এই দুটো কারণের মধ্যে কোন্‌টা সত্য সেটা কৌশলে অনিশ্চিত রাখা হয়েছে।


পৃথ্বীশ কখন এক সময় পা টিপে টিপে একটা চেয়ারে এসে বসেছে পিছন দিকে। বাঁশরি জানতে পারে নি। পড়া হয়ে যেতেই বাঁশরি খাতাখানা যখন ধপ করে ফেললে টেবিলের উপর- পৃথ্বীশ সামনে এসে বললে, ‘কেমন লাগল। মেলোড্রামার খাদ মিশোই নি এক তোলাও। সেন্টিমেন্টালিটির তরল রস চায় যারা তাদের পক্ষে নির্জলা একাদশী; একেবারে নিষ্ঠুর সত্য।’
বাঁশরি বললে, ‘কেমন লাগল? এই দেখিয়ে দিচ্ছি।’ বলে পাতাগুলো ছিঁড়তে লাগল একটার পর একটা। পৃথ্বীশ বললে, ‘করলে কী? আমার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখা নষ্ট করলে, তা জান।’
‘কী দাম চাই?’


‘তোমাকে।’
‘আমাকে? নিতে সাহস আছে তোমার?’
‘আছে।’
সেন্টিমেন্ট এক ফোঁটাও থাকবে না।’
‘নেই রইল।’
‘নির্জলা একাদশী, নিষ্ঠুর সত্য।’
‘রাজি আছি।’
‘আচ্ছা, রাজি? দেখো, নভেল লেখা নয়, সত্যিকার সংসার।’
‘শিশু নই আমি, এ কথা বুঝি।’


‘না মশায়, কিছু বোঝ না। বুঝতে হবে দিনে- দিনে পলে- পলে, বুঝতে হবে হাড়ে- হাড়ে।’
‘সেই হবে আমার জীবনের সব চেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা। আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না কিছুতেই।’
‘সত্যি কথা বলি। এত দিন তোমাকে কাছে কাছেই দেখলুম, বুদ্ধি তোমার পাকে নি, তাই কেবলই ধার ক’রে কাজ চালাও। মেয়েদের সম্বন্ধে বইপড়া কথা অনেক শুনেছি তোমার মুখে। একটা কথা শুনে রাখো, যারা অবুঝ তাদের উপর মেয়েদের খুব একটা টান আছে, যেমন মমতা রোগাদের ‘পরে। ওদের ভার পেলে মেয়েদের বেকার দশা ঘোচে। তোমার উপর আমার সত্যিকার স্নেহ জন্মেছে। এতদিন তোমাকে বাঁচিয়ে এসেছি তোমার নিজের নির্বুদ্ধিতা আর বাইরের বিরুদ্ধতা থেকে। সেইজন্যে যে সর্বনেশে প্রস্তাব এইমাত্র করলে সেটাতে সম্মতি দিতে আমার দয়া হচ্ছে।’


‘সম্মতি যদি না দাও তা হলে যে নির্দয়তা হবে তার তুলনা নেই।’
‘মেলোড্রামা?’
‘না, মেলোড্রামা নয়।’
‘আজ না হোক কাল মেলোড্রামা হয়ে উঠবে না?’
‘যদি কোনোদিন হয়ে ওঠে তবে ওই খাতার মতো দিনগুলোকে নিজের হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ো।’
বাঁশরি উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আচ্ছা দিলেম সম্মতি।’
পৃথ্বীশ ওর দিকে লাফ দিয়ে এল। বাঁশরি পিছু হঠে গিয়ে বললে, ‘এখনি শুরু হল! এখনো ভালো করে ভেবে দেখো- পিছোবার সময় আছে।’


পৃথ্বীশ হাত জোড় করে বললে, ‘মাপ করো আমাকে। ভয় হচ্ছে পাছে তোমার মত বদলায়।’
‘বদলাবে না। অমন করে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকো না। যাও রেজিস্ট্রারের আপিসে। যত শীঘ্র পার বিয়ে হওয়া চাই। নিমন্ত্রণের চিঠি ছাপতে দিয়ো আজই।’
‘অনুষ্ঠান কিছু হবে না?’
‘কিছু না, একেবারে নির্জলা একাদশী।’
‘কাউকে নিমন্ত্রণ?’
‘কাউকে না।’
‘কাউকেই না?’


‘আচ্ছা, সোমশংকরকে। আর- একটা কথা বলি, গল্পটার কপি নিশ্চয় আছে তোমার ডেস্কে, সেটা পুড়িয়ে ফেলো, নইলে শান্তি পাবে না আমার হাতে।’
পরের দিন সোমশংকর এল। বাঁশি বললে, ‘তুমি যে।’
‘নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। জানি অন্য পক্ষ থেকে তোমাকে নিমন্ত্রণ করবে না। কিন্তু আমার দিক থেকে কোনো সংকোচ নেই।’
‘কেন নেই?’
‘একদিন আমি তোমাকে যা দিয়েছি আর তুমি আমাকে যা দিয়েছ এ বিবাহে তাকে কিছুমাত্র স্পর্শ করবে না তা তুমি জান।’
‘তবে বিবাহ করতে যাচ্ছ কেন?’
‘সে কথা বুঝতে যদি নাও পার, তবু আমার উপর দয়া কোরো।’


‘নাই- বা বুঝলুম, তুমি বলো।’
‘সন্ন্যাসীর কাছ থেকে যে ব্রত নিয়েছি বোঝাতে পারব না সে, আমার ভালোবাসার চেয়ে বড়ো। তাকে সম্পন্ন করতেই হবে বাঁচি আর মরি।’
‘আমাকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন হতে পারত না?’
‘যদি পারত তবে বাধা ঘটত না। তুমি নিজেকে ভুল বোঝাও না, তাই জানি, তুমি নিশ্চিত জানো তোমার ভালোবাসা টলিয়ে দিল আমাকে কেন্দ্র থেকে। তোমার কাছে আমি দুর্বল। যে দুঃসাধ্য কর্মে সুষমার সঙ্গে সন্ন্যাসী আমাকে মিলিয়েছেন, সেখানে আমাদের বিচলিত হবার অবকাশ নেই। সেখানে ভালোবাসার প্রবেশপথ বন্ধ।’


অশ্রু গোপন করার জন্যে চোখ নিচু করে বাঁশরি বললে, ‘এখনো সম্পূর্ণ করে বলো নি, কেন এলে আজ আমার এখানে?’
‘আমার ভালোবাসার কিছু চিহ্ন রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে, ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’
ডুব সাঁতার দিয়ে জল থেকে তুলে এনেছিল, সেই কন্ঠী, সেই ব্রেসলেট, সেই ব্রোচ। ধরলে বাঁশরির সামনে। বাঁশরি বললে, ‘মনে করেছিলাম হারিয়েছে, ফিরে পেয়ে আরো বেশি করে পেলুম। নিজের হাতে পরিয়ে দাও আমাকে।’


সোমশংকর একে- একে গয়নাগুলি পরিয়ে দিলে যত্ন করে। বাঁশরি বললে, ‘শক্ত আমার প্রাণ, তোমার কাছেও কোনো দিন কেঁদেছি ব’লে মনে পড়ে না। আজকে যদি কাঁদি কিছু মনে কোরো না।’ এই ব’লে মাথা রাখল সোমশংকরের বুকের উপর।
বিবাহের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা। সুষমাদের যে- ঘরে বিবাহ- সভা বসবে, যেখানে আসন পড়বে বর- কনের, সেখান থেকে সমস্ত লোকজন সরিয়ে দিয়ে, সুষমা একলা বসে মেঝের উপর একটা পদ্মফুলের আলপনা এঁকেছে। থালায় আছে নানা জাতের ফুল ফল, ধূপ জ্বলছে, ইলেকট্রিক আলো নিবিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। ঘরের দ্বারের কাছে সুষমা বসে আছে চুপ করে। মুক্তারামকে ডেকে পাঠিয়েছে। এখনি সে আসবে।


এল মুক্তারাম। সুষমা অনেক্ষণ তার পায়ের উপর মাথা দিয়ে রইল পড়ে। তার পর সেই আলপনা- কাটা জায়গায় আসন পেতে বসালে তাকে। বললে, ‘প্রভু দুর্বল আমি, মনের গোপনে যদি পাপ থাকে আজ সমস্ত ধুয়ে দাও। আমার সমস্ত আসক্তি দূর হোক, জয়যুক্ত হোক তোমার বাণী। আজ সন্ধ্যায় এইখানে তোমার প্রসন্ন দৃষ্টির সামনে তোমার চরণস্পর্শে আমার নতুন জীবন আরম্ভ হোক। কাল থেকে তোমার ব্রতের পথে যাত্রা করে চলব শেষ দিন পর্যন্ত।’


মুক্তারাম উঠে দাঁড়ালে। কোনো কথা না বলে ডান হাতে স্পর্শ করলে সুষমার মাথা। সুষমা থালা থেকে ফুলগুলি নিয়ে মুক্তারামের দুই পা ঢেকে দিলে।
পৃথ্বীশ একখানা চিঠি পেলে। চলে গেল সব কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ডেরাদুনে, একটা নিষ্ঠুর গল্প লেখবার জন্য। সকলের চেয়ে কালিমা লেপনে পূজনীয়ের চরিত্রে। এই তার প্রতিশোধ, তার সান্ত্বনা। পাঠকেরা বুঝলে কাদের লক্ষ্য করে লেখা, উপভোগ করলে কুৎসা, বললে এইটে নবযুগের বাংলা সাহিত্যের একটা শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য। একজন ভক্ত যখন লেখাটা মুক্তারামকে দেখালে, মুক্তারাম বললে- ‘লেখকের শক্তি আছে রচনার।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a Comment