কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা নিয়ে আমাদের এই নিবন্ধটি। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সমগ্র একটি আলোচিত ও জনপ্রিয় বিষয়। পূর্ববাংলা থেকে শুরু করে পশ্চিম বাংলায় সমান ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট গল্প সমাদৃত। বাংলা উপন্যাস পড়তে গেলে সবার আগে চলে আসে কবি গুরুর নাম।
ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা বর্ষামঙ্গল
ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
গুরুগর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,
উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে।
নিখিলচিত্তহরষা
ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।
কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,
জনপদবধূ তড়িৎচকিতনয়না,
মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,
কোথা তোরা অভিসারিকা!
ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,
ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরশনা,
আনো বীণা মনোহারিকা।
কোথা বিরহিণী, কোথা তোরা অভিসারিকা!
আনো মৃদঙ্গ, মুরজ, মুরলী মধুরা,
বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধূরা-
এসেছে বরষা, ওগো নব- অনুরাগিণী,
ওগো প্রিয়সুখভাগিনী!
কুঞ্জকুটিরে, অয়ি ভাবাকুললোচনা,
ভূর্জপাতায় নব গীত করো রচনা
মেঘমল্লার- রাগিণী।
এসেছে বরষা, ওগো নব- অনুরাগিণী!
কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,
ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী,
কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,
অঞ্জন আঁকো নয়নে।
তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া
ভবনশিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া
স্মিতবিকশিত বয়নে,
কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে।
স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে,
শশীতারাহীনা অন্ধতামসী যামিনী-
কোথা তোরা পুরকামিনী!
আজিকে দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে,
জনহীন পথ কাঁদিছে ক্ষুব্ধ পবনে,
চমকে দীপ্ত দামিনী-
শূন্যশয়নে কোথা জাগে পুরকামিনী!
যূথীপরিমল আসিছে সজল সমীরে,
ডাকিছে দাদুরী তমালকুঞ্জতিমিরে,
জাগো সহচরী, আজিকার নিশি ভুলো না-
নীপশাখে বাঁধো ঝুলনা।
কুসুমপরাগ ঝরিবে ঝলকে ঝলকে,
অধরে অধরে মিলন অলকে অলকে-
কোথা পুলকের তুলনা।
নীপশাখে সখী ফুলডোরে বাঁধো ঝুলনা।
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা-
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতিময় তরুলতিকা।
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা-
শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা বন্দী বীর
পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে শিখড্ড
নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে গুরুজির জয়
ধ্বনিয়া তুলেছে দিক্।
নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে
চাহিল নির্নিমিখ।
“অলখ নিরঞ্জন’
মহারব উঠে বন্ধন টুটে
করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে
অসি বাজে ঝন্ঝন্।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল,
“অলখ নিরঞ্জন!’
এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে
না রাখে কাহারো ঋণ।
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,
চিত্ত ভাবনাহীন।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর
এসেছে সে এক দিন।
দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কাদের কণ্ঠে গগন মন্থ,
নিবিড় নিশীথ টুটে-
কাদের মশালে আকাশের ভালে
আগুন উঠেছে ফুটে!
পঞ্চনদীর তীরে
ভক্তদেহের রক্তলহরী
মুক্ত হইল কি রে!
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
ছুটে যেন নিজনীড়ে।
বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালো
পঞ্চনদীর তীরে।
মোগল- শিখের রণে
মরণ- আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
দুইজনা দুইজনে।
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ
যুঝে ভুজঙ্গ- সনে।
সেদিন কঠিন রণে
“জয় গুরুজির’ হাঁকে শিখ বীর
সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
“দীন্ দীন্’ গরজনে।
গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দী যখন বন্দী হইল
তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খল গত
বাঁধি লয়ে গেল ধরে
দিল্লিনগর- ‘পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
গুরুদাসপুর গড়ে।
সম্মুখে চলে মোগল- সৈন্য
উড়ায়ে পথের ধূলি,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
বর্শাফলকে তুলি।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে,
বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ- ‘পরে লোক নাহি ধরে,
বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয়, “গুরুজির জয়’
পরানের ভয় ভুলি।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে
দিল্লিপথের ধূলি।
পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
বন্দীরা সারি সারি
“জয় গুরুজির’ কহি শত বীর
শত শির দেয় ডারি।
সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ
নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
বন্দার এক ছেলে।
কহিল, “ইহারে বধিতে হইবে
নিজহাতে অবহেলে।’
দিল তার কোলে ফেলে
কিশোর কুমার, বাঁধা বাহু তার,
বন্দার এক ছেলে।
কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে
লইল বক্ষে টানি।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে
রাখে দক্ষিণ পাণি,
শুধু একবার চুম্বিল তার
রাঙা উষ্ণীষখানি।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
ছুরিকা খসায়ে আনি
বালকের মুখ চাহি
“গুরুজির জয়’ কানে কানে কয়,
“রে পুত্র, ভয় নাহি।’
নবীন বদনে অভয় কিরণ
জ্বলি উঠি উৎসাহি
কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল
বালক উঠিল গাহি
“গুরুজির জয়! কিছু নাহি ভয়’
বন্দার মুখ চাহি।
বন্দা তখন বামবাহুপাশ
জড়াইল তার গলে,
দক্ষিণ করে ছেলের বক্ষে
ছুরি বসাইল বলেড্ড
“গুরুজির জয়’ কহিয়া বালক
লুটালো ধরণীতলে।
সভা হল নিস্তব্ধ
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক
সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি’
একটি কাতর শব্দ।
দর্শনজন মুদিল নয়ন,
সভা হল নিস্তব্ধ।
- আরও পড়ুন:
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী
- ১৫ টি সেরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা মানী
আরঙজেব ভারত যবে
করিতেছিল খান- খান
মারবপতি কহিলা আসি,
“করহ প্রভু অবধান,
গোপন রাতে অচলগড়ে
নহর যাঁরে এনেছ ধরে
সিরোহিপতি সুরতান।
কী অভিলাষ তাঁহার ‘পরে
আদেশ মোরে করো দান।’
শুনিয়া কহে আরঙজেব,
“কি কথা শুনি অদ্ভুত!
এতদিনে কি পড়িল ধরা
অশনিভরা বিদ্যুৎ?
পাহাড়ি লয়ে কয়েক শত
পাহাড়ে বনে ফিরিতে রত
মরুভূমির মরীচি- মতো
স্বাধীন ছিল রাজপুত!
দেখিতে চাহি, আনিতে তারে
পাঠাও কোনো রাজদূত।’
মাড়োয়ারাজ যশোবন্ত
কহিলা তবে জোড়কর,
“ক্ষত্রকুলসিংহশিশু
লয়েছে আজি মোর ঘর-
বাদশা তাঁরে দেখিতে চান,
বচন আগে করুন দান
কিছুতে কোনো অসম্মান
হবে না কভু তাঁর ‘পর
সভায় তবে আপনি তাঁরে
আনিব করি সমাদর।’
আরঙজেব কহিলা হাসি,
“কেমন কথা কহ আজ!
প্রবীণ তুমি প্রবল বীর
মাড়োয়াপতি মহারাজ।
তোমার মুখে এমন বাণী
শুনিয়া মনে শরম মানি,
মানীর মান করিব হানি
মানীরে শোভে হেন কাজ?
কহিনু আমি, চিন্তা নাহি,
আনহ তাঁরে সভামাঝ।’
সিরোহিপতি সভায় আসে
মাড়োয়ারাজে লয়ে সাথ,
উচ্চশির উচ্চ রাখি
সমুখে করে আঁখিপাত
কহিল সবে বজ্রনাদে
“সেলাম করো বাদশাজাদে’-
হেলিয়া যশোবন্ত- কাঁধে
কহিলা ধীরে নরনাথ,
“গুরুজনের চরণ ছাড়া
করি নে কারে প্রণিপাত।’
কহিলা রোষে রক্ত- আঁখি
বাদশাহের অনুচর,
“শিখাতে পারি কেমনে মাথা
লুটিয়া পড়ে ভূমি- ‘পর।’
হাসিয়া কহে সিরহিপতি,
“এমন যেন না হয় মতি
ভয়েতে কারে করিব নতি,
জানি নে কভু ভয়- ডর।’
এতেক বলি দাঁড়ালো রাজা
কৃপাণ- ‘পরে করি ভর।
বাদশা ধরি সুরতানেরে
বসায়ে নিল নিজপাশ-
কহিলা, “বীর, ভারত- মাঝে
কী দেশ- ‘পরে তব আশ?’
কহিলা রাজা, “অচলগড়
দেশের সেরা জগৎ- ‘পর।’
সভার মাঝে পরস্পর
নীরবে উঠে পরিহাস।
বাদশা কহে, “অচল হয়ে
অচলগড়ে করো বাস।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা প্রার্থনাতীত দান
শিখের পক্ষে বেণীচ্ছেদন
ধর্মপরিত্যাগের ন্যায় দূষণীয়
পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল
বন্দী শিখের দল-
সুহিদ্গঞ্জ রক্তবরন
হইল ধরণীতল।
নবাব কহিল, “শুন তরুসিং,
তোমারে ক্ষমিতে চাই।’
তরুসিং কহে, “মোরে কেন তব
এত অবহেলা ভাই?’
নবাব কহিল, “মহাবীর তুমি,
তোমারে না করি ক্রোধ-
বেণীটি কাটিয়া দিয়ে যাও মোরে
এই শুধু অনুরোধ।’
তরুসিং কহে, “করুণা তোমার
হৃদয়ে রহিল গাঁথা-
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব,
বেণীর সঙ্গে মাথা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা গুরু গোবিন্দ
“বন্ধু, তোমরা ফিরে যাও ঘরে
এখনো সময় নয়’-
নিশি অবসান, যমুনার তীর,
ছোটো গিরিমালা, বন সুগভীর,
গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া
অনুচর গুটি ছয়।
“যাও রামদাস, যাও গো লেহারি,
সাহু, ফিরে যাও তুমি।
দেখায়ো না লোভ, ডাকিয়ো না মোরে
ঝাঁপায়ে পড়িত কর্মসাগরে-
এখনো পড়িয়া থাক্ বহু দূরে
জীবনরঙ্গভূমি।
“ফিরায়েছি মুখ, রুধিয়াছি কান,
লুকায়েছি বনমাঝে।
সুদূরে মানবসাগর অগাধ
চিরক্রন্দিত- ঊর্মি- নিনাদ,
হেথায় বিজনে রয়েছি মগন
আপন গোপন কাজে।
“মানবের প্রাণ ডাকে যেন মোরে
সেই লোকালয় হতে।
সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই
চমকিয়া উঠে বলি “যাই যাই’,
প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই
প্রবল মানবস্রোতে।
তোমাদের হেরি চিত চঞ্চল,
উদ্দাম ধায় মন।
রক্ত- অনল শত শিখা মেলি
সর্পসমান করি উঠে কেলি,
গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন
কোষমাঝে ঝন্ ঝন্।
“হায়, সেকি সুখ, এ গহন ত্যজি
হাতে লয়ে জয়তুরী
জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে,
রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে,
অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া
হানিতে তীক্ষ্ন ছুরি!
“তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি,
বন্ধন করি তায়
রশ্মি পাকড়ি আপনার করে
বিঘ্ন বিপদ লঙ্ঘন ক’রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
প্রতিকূল ঘটনায়।
“সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ,
পড়ে যায় কেহ ভূমে।
দ্বিধা হয়ে বাধা হতেছে ভিন্ন,
পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন,
আকাশের আঁখি করিছে খিন্ন
প্রলয়বহ্নিধূমে।
“শত বার করে মৃত্যু ডিঙায়ে
পড়ি জীবনের পাড়ে।
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক,
লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
গরজিছে দুই ধারে।
“কভু অমানিশা নীরব নিবিড়,
কভু বা প্রখর দিন।
কভু বা আকাশে চারি- দিক- ময়
বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়ো হয়,
কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে
ভেঙে পড়ে দয়াহীন।
“আয় আয় আয়’ ডাকিতেছি সবে,
আসিতেছে সবে ছুটে।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার,
সুখ সম্পদ মায়া মমতার
বন্ধন যায় টুটে।
“সিন্ধুমাঝারে মিশিছে যেমন
পঞ্চ নদীর জল,
আহ্বান শুনে কে কারে থামায়,
ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায়,
পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া
উন্মাদ কোলাহল।
“কোথা যাবি ভীরু, গহন গোপনে
পশিছে কণ্ঠ মোর।
প্রভাতে শুনিয়া “আয় আয় আয়’
কাজের লোকেরা কাজ ভুলে যায়,
নিশীথে শুনিয়া “আয় তোরা আয়’
ভেঙে যায় ঘুমঘোর।
“যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক,
ভরে যায় ঘাট বাট।
ভুলে যায় সবে জাত- অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান অপমান
ব্রাহ্মণ আর জাঠ।
“থাক্ ভাই, থাক্, কেন এ স্বপন-
এখনো সময় নয়।
এখনো একাকী দীর্ঘ রজনী
জাগিতে হইবে পল গণি গণি
অনিমেষ চোখে পূর্ব গগনে
দেখিতে অরুণোদয়।
“এখনো বিহার কল্পজগতে,
অরণ্য রাজধানী-
এখনো কেবল নীরব ভাবনা,
কর্মবিহীন বিজন সাধনা,
দিবানিশি শুধু বসে বসে শোনা
আপন মর্মবাণী।
“একা ফিরি তাই যমুনার তীরে
দুর্গমগিরিমাঝে।
মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে,
মিশাতেছি গান নদীকলরোলে,
গড়িতেছি মন আপনার মনে,
যোগ্য হতেছি কাজে।
“এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
আরো কতদিন হবে!
চারি দিক হতে অমর জীবন
বিন্দু বিন্দু করি আহরণ
আপনার মাঝে আপনারে আমি
পূর্ণ দেখিব কবে!
“কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব-
“পেয়েছি আমার শেষ!
তোমরা সকলে এসো মোর পিছে,
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে,
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ!
“নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
নাহি আর আগু- পিছু।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ-
নাই তার কাছে জীবন মরণ,
নাই নাই আর কিছু।’
“হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মতো-
“উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,
ওই চেয়ে দেখো কতদূর হতে
তোমার কাছেতে ধরা দিবে ব’লে
আসে লোক কত শত।
“ওই শোনো শোনো কল্লোলধ্বনি,
ছুটে হৃদয়ের ধারা।
স্থির থাকো তুমি, থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতো আলস তেয়াগি,
এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা।’
“ওই চেয়ে দেখো দিগন্ত- পানে
ঘনঘোর ঘটা অতি।
আসিতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে-
তাই বসে বসে হৃদয়- আলয়ে
জ্বালাতেছি আলো, নিবিবে না ঝড়ে,
দিবে অনন্ত জ্যোতি।
“যাও তবে সাহু, যাও রামদাস,
ফিরে যাও সখাগণ।
এসো দেখি সবে যাবার সময়
বলো দেখি সবে “গুরুজির জয়’,
দুই হাত তুলি বলো “জয় জয়
অলখ নিরঞ্জন’।’
বলিতে বলিতে প্রভাততপন
উঠিল আকাশ- ‘পরে।
গিরির শিখারে গুরুর মূরতি
কিরণছটায় প্রোজ্জ্বল অতি-
বিদায় মাগিল অনুচরগণ,
নমিল ভক্তিভরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা সূচনা
কথা কও, কথা কও।
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে
কেন বসে চেয়ে রও?
কথা কও, কথা কও।
যুগযুগান্ত ঢালে তার কথা
তোমার সাগরতলে,
কত জীবনের কত ধারা এসে
মিশায় তোমার জলে।
সেথা এসে তার স্রোত নাহি আর,
কলকল ভাষ নীরব তাহার-
তরঙ্গহীন ভীষণ মৌন,
তুমি তারে কোথা লও!
হে অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার
কথা কও, কথা কও।
কথা কও, কথা কও।
স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,
অচেতন তুমি নও-
কথা কেন নাহি কও!
তব সঞ্চার শুনেছি আমার
মর্মের মাঝখানে,
কত দিবসের কত সঞ্চয়
রেখে যাও মোর প্রাণে!
হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে,
মুখর দিনের চপলতা- মাঝে
স্থির হয়ে তুমি রও।
হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে
কথা কও, কথা কও।
কথা কও, কথা কও।
কোনো কথা কভু হারাও নি তুমি,
সব তুমি তুলে লও-
কথা কও, কথা কও।
তুমি জীবনের পাতায় পাতায়
অদৃশ্য লিপি দিয়া
পিতামহদের কাহিনী লিখিছ
মজ্জায় মিশাইয়া।
যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই
তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই,
বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী
স্তম্ভিত হয়ে বও।
ভাষা দাও তারে হে মুনি অতীত,
কথা কও, কথা কও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা চৌরপঞ্চাশিকা
ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
গুরুগর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,
উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে।
নিখিলচিত্তহরষা
ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।
কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,
জনপদবধূ তড়িৎচকিতনয়না,
মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,
কোথা তোরা অভিসারিকা!
ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,
ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরশনা,
আনো বীণা মনোহারিকা।
কোথা বিরহিণী, কোথা তোরা অভিসারিকা!
আনো মৃদঙ্গ, মুরজ, মুরলী মধুরা,
বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধূরা-
এসেছে বরষা, ওগো নব- অনুরাগিণী,
ওগো প্রিয়সুখভাগিনী!
কুঞ্জকুটিরে, অয়ি ভাবাকুললোচনা,
ভূর্জপাতায় নব গীত করো রচনা
মেঘমল্লার- রাগিণী।
এসেছে বরষা, ওগো নব- অনুরাগিণী!
কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,
ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী,
কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,
অঞ্জন আঁকো নয়নে।
তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া
ভবনশিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া
স্মিতবিকশিত বয়নে,
কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে।
স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল দিবসে
বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে,
শশীতারাহীনা অন্ধতামসী যামিনী-
কোথা তোরা পুরকামিনী!
আজিকে দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে,
জনহীন পথ কাঁদিছে ক্ষুব্ধ পবনে,
চমকে দীপ্ত দামিনী-
শূন্যশয়নে কোথা জাগে পুরকামিনী!
যূথীপরিমল আসিছে সজল সমীরে,
ডাকিছে দাদুরী তমালকুঞ্জতিমিরে,
জাগো সহচরী, আজিকার নিশি ভুলো না-
নীপশাখে বাঁধো ঝুলনা।
কুসুমপরাগ ঝরিবে ঝলকে ঝলকে,
অধরে অধরে মিলন অলকে অলকে-
কোথা পুলকের তুলনা।
নীপশাখে সখী ফুলডোরে বাঁধো ঝুলনা।
এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা-
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতিময় তরুলতিকা।
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা-
শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা স্বপ্ন
দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোধ্ররেণু লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে।
মহাকাল মন্দিরের মাঝে
তখন গম্ভীর মন্দ্রে সন্ধ্যারতি বাজে।
জনশূন্য পণ্যবীথি, ঊর্ধ্বে যায় দেখা
অন্ধকার হর্ম্য- ‘পরে সন্ধ্যারশ্মিরেখা।
প্রিয়ার ভবন
বঙ্কিম সংকীর্ণ পথে দুর্গম নির্জন।
দ্বারে আঁকা শঙ্খ চক্র, তারি দুই ধারে
দুটি শিশু নীপতরু পুত্রস্নেহে বাড়ে।
তোরণের স্বেতস্তম্ভ- ‘পরে
সিংহের গম্ভীর মূর্তি বসি দম্ভভরে।
প্রিয়ার কপোতগুলি ফিরে এল ঘরে,
ময়ূর নিদ্রায় মগ্ন স্বর্ণদণ্ড- ‘পরে।
হেনকালে হাতে দীপশিখা
ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা।
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সোপানের- ‘পরে
সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো সন্ধ্যাতারা করে।
অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস
ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস।
প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন- অন্তরে
চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে।
দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়
নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়।
মোরে হেরি প্রিয়া
ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া
আইল সম্মুখে- মোর হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধাল শুধু, সকরুণ আঁখি,
“হে বন্ধু আছ তো ভালো?’ মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু, কথা আর নাহি।
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি, নাম দোঁহাকার
দুজনে ভাবিনু কত- মনে নাহি আর।
দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা- পানে,
অঝোরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে।
দুজনে ভাবিনু কত দ্বারতরুতলে!
নাহি জানি কখন কি ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণ করে কুলায়প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো, মুখখানি তার
নতবৃন্তপদ্মসম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে, ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস।
রজনীর অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার।
দীপ দ্বারপাশে
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে।
শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা মার্জনা
ওগো প্রিয়তম, আমি তোমারে যে ভালোবেসেছি
মোরে দয়া করে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ভীরু পাখির মতন তব পিঞ্জরে এসেছি,
ওগো, তাই ব’লে দ্বার কোরো না রুদ্ধ কোরো না
মোর যাহা- কিছু ছিল কিছুই পারি নি রাখিতে,
মোর উতলা হৃদয় তিলেক পারি নি ঢাকিতে,
সখা, তুমি রাখো ঢাকো, তুমি করো মোরে করুণা-
ওগো, আপনার গুণে অবলারে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ওগো প্রিয়তম, যদি নাহি পার ভালোবাসিতে
তবু ভালোবাসা কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
তব দুটি আঁখিকোণ ভরি দুটি কণা হাসিতে
এই অসহায়া- পানে চেয়ো না, বন্ধু, চেয়ো না।
আমি সম্বরি বাস ফিরে যাব দ্রুতচরণে,
আমি চকিত শরমে লুকাব আঁধার মরণে,
আমি দু- হাতে ঢাকিব নগ্নহৃদয়বেদনা-
ওগো প্রিয়তম, তুমি অভাগীরে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ওগো প্রিয়তম যদি চাহ মোরে ভালোবাসিয়া
মোর সুখরাশি কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
যবে সোহাগের স্রোতে যাব নিরুপায় ভাসিয়া
তুমি দূর হতে বসি হেসো না গো সখা, হেসো না।
যবে রানীর মতন বসিব রতন- আসনে,
যবে বাঁধিব তোমারে নিবিড় প্রণয়শাসনে,
যবে দেবীর মতন পুরাব তোমার বাসনা-
ওগো তখন, হে নাথ, গরবীরে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা চৈত্ররজনী
আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো
চৈত্রনিশীথশশী!
তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে
কী দেখিছ একা বসি
চৈত্রনিথীথশশী!
কত নদীতীরে, কত মন্দিরে,
কত বাতায়নতলে,
কত কানাকানি, মন- জানাজানি,
সাধাসাধি কত ছলে!
শাখাপ্রশাখার, দ্বার- জানালার
আড়ালে আড়ালে পশি
কত সুখদুখ কত কৌতুক
দেখিতেছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।
মোরে দেখো চাহি, কেহ কোথা নাহি,
শূন্য ভবন- ছাদে
নৈশ পবন কাঁদে।
তোমারি মতন একাকী আপনি
চাহিয়া রয়েছি বসি
চৈত্রনিশীথশশী!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোট কবিতা গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।