Kobi Guru Rabindranath Thakur Kobita: এই নিবন্ধে তুলে ধরছি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা কৃষ্ণকলি, কবি, সোজাসুজি, বিরহ, আবির্ভাব কবিতা সমগ্র। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, চিত্রকর ও সংগীতজ্ঞ।
Kobi Guru Rabindranath Thakur Kobita
১. কৃষ্ণকলি
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ- চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ- পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল- বনে।
এমনি করে শ্রাবণ- রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ- চোখ।
মাথার ‘পরে দেয় নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ।
২. কবি
আমি যে বেশ সুখে আছি
অন্তত নই দুঃখে কৃশ,
সে কথাটা পদ্যে লিখতে
লাগে একটু বিসদৃশ।
সেই কারণে গভীর ভাবে
খুঁজে খুঁজে গভীর চিতে
বেরিয়ে পড়ে গভীর ব্যথা
স্মৃতি কিম্বা বিস্মৃতিতে।
কিন্তু সেটা এত সুদূর
এতই সেটা অধিক গভীর
আছে কি না আছে তাহার
প্রমাণ দিতে হয় না কবির।
মুখের হাসি থাকে মুখে,
দেহের পুষ্টি পোষে দেহ,
প্রাণের ব্যথা কোথায় থাকে
জানে না সেই খবর কেহ।
কাব্য প’ড়ে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো।
আঁধার ক’রে রাখে নি মুখ,
দিবারাত্র ভাঙছে না বুক,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
হাস্যমুখেই বয় গো।
- আরও পড়ুন:
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন
- বন্ধু নিয়ে কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভালোবাসে ভদ্রসভায়
ভদ্র পোশাক পরতে অঙ্গে,
ভালোবাসে ফুল্ল মুখে
কইতে কথা লোকের সঙ্গে।
বন্ধু যখন ঠাট্টা করে
মরে না সে অর্থ খুঁজে,
ঠিক যে কোথায় হাসতে হবে
একেক সময় দিব্যি বুঝে।
সামনে যখন অন্ন থাকে
থাকে না সে অন্যমনে,
সন্গীদলের সাড়া পেলে
রয় না বসে ঘরের কোণে।
বন্ধুরা কয় “লোকটা রসিক’,
কয় কি তারা মিথ্যামিথ্যি?
শত্রুরা কয় “লোকটা হাল্কা’,
কিছু কি তার নাইকো ভিত্তি?
কাব্য দেখে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো।
চাঁদের পানে চক্ষু তুলে
রয় না পড়ে নদীর কূলে,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
মনের সুখেই বয় গো।
সুখে আছি লিখতে গেলে
লোকে বলে, “প্রাণটা ক্ষুদ্র!
আশাটা এর নয়কো বিরাট,
পিপাসা এর নয়কো রুদ্র।’
পাঠকদলে তুচ্ছ করে,
অনেক কথা বলে কঠোর-
বলে, “একটু হেসে- খেলেই
ভরে যায় এর মনের জঠর।’
কবিরে তাই ছন্দে বন্ধে
বানাতে হয় দুখের দলিল।
মিথ্যা যদি হয় সে তবু
ফেলো পাঠক চোখের সলিল।
তাহার পরে আশিস কোরো
রুদ্ধকণ্ঠে ক্ষুব্ধবুকে,
কবি যেন আজন্মকাল
দুখের কাব্য লেখেন সুখে।
কাব্য যেমন কবি যেন
তেমন নাহি হয় গো।
বুদ্ধি যেন একটু থাকে,
স্নানাহারের নিয়ম রাখে,
সহজ লোকের মতোই যেন
সরল গদ্য কয় গো।
৩. সোজাসুজি
হৃদয়- পানে হৃদয় টানে,
নয়ন- পানে নয়ন ছোটে,
দুটি প্রাণীর কাহিনীটা
এইটুকু বৈ নয়কো মোটে।
শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে
হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে-
আমার বাঁশি লুটায় ভূমে,
তোমার কোলে ফুলের পুঁজি।
তোমার আমার এই- যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি।
বাসন্তী- রঙ বসনখানি
নেশার মতো চক্ষে ধরে,
তোমার গাঁথা যূথীর মালা
স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে।
একটু দেওয়া একটু রাখা,
একটু প্রকাশ একটু ঢাকা,
একটু হাসি একটু শরম-
দুজনের এই বোঝাবুঝি।
তোমার আমার এই- যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি।
মধুমাসের মিলন- মাঝে
মহান কোনো রহস্য নেই,
অসীম কোনো অবোধ কথা
যায় না বেধে মনে- মনেই।
আমাদের এই সুখের পিছু
ছায়ার মতো নাইকো কিছু,
দোঁহার মুখে দোঁহে চেয়ে
নাই হৃদয়ের খোঁজাখুঁজি।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি।
ভাষার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে
খুঁজি নে ভাই ভাষাতীত,
আকাশ- পানে বাহু তুলে
চাহি নে ভাই আশাতীত।
যেটুকু দিই যেটুকু পাই
তাহার বেশি আর কিছু নাই-
সুখের বক্ষ চেপে ধরে
করি নে কেউ যোঝাযুঝি।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি।
শুনেছিনু প্রেমের পাথার
নাইকো তাহার কোনো দিশা,
শুনেছিনু প্রেমের মধ্যে
অসীম ক্ষুধা অসীম তৃষা-
বীণার তন্ত্রী কঠিন টানে
ছিঁড়ে পড়ে প্রেমের তানে,
শুনেছিনু প্রেমের কুঞ্জে
অনেক বাঁকা গলিঘুঁজি।
আমাদের এই দোঁহার মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি।
৪. বিরহ
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই- পহর-
সূর্য তখন মাঝ- গগনে,
রৌদ্র খরতর।
ঘরের কর্ম সাঙ্গ করে
ছিলেম তখন একলা ঘরে,
আপন- মনে বসে ছিলেম
বাতায়নের ‘পর।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই- পহর।
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা গন্ধ নিয়ে
আসতেছিল তপ্ত হাওয়া
মুক্ত দুয়ার দিয়ে।
দুটি ঘুঘু সারাটা দিন
ডাকতেছিল শ্রান্তিবিহীন,
একটি ভ্রমর ফিরতেছিল
কেবল গুন্গুনিয়ে
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা বার্তা নিয়ে।
তখন পথে লোক ছিল না,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম।
ঝাউশাখাতে উঠতেছিল
শব্দ অবিশ্রাম।
আমি শুধু একলা প্রাণে
অতি সুদূর বাঁশির তানে
গেঁথেছিলেম আকাশ ভ’রে
একটি কাহার নাম।
তখন পথে লোক ছিল না,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া,
আমি ছিলেম জেগে-
আবাঁধা চুল উড়তে ছিল
উদাস হাওয়া লেগে।
তটতরুর ছায়ার তলে
ঢেউ ছিল না নদীর জলে,
তপ্ত আকাশ এলিয়ে ছিল
শুভ্র অলস মেঘে।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া,
আমি ছিলেম জেগে।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই- পহর,
শুষ্ক পথে দগ্ধ মাঠে
রৌদ্র খরতর।
নিবিড়- ছায়া বটের শাখে
কপোত দুটি কেবল ডাকে
একলা আমি বাতায়নে-
শূন্য শয়ন- ঘর।
তুমি যখন গেলে তখন
বেলা দুই- পহর।
৫. আবির্ভাব
বহুদিন হল কোন্ ফাল্গুনে
ছিনু আমি তব ভরসায়;
এলে তুমি ঘন বরষায়।
আজি উত্তাল তুমুল ছন্দে
আজি নবঘন- বিপুল- মন্দ্রে
আমার পরানে যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায়।
দূরে একদিন দেখেছিনু তব
কনকাঞ্চল- আবরণ,
নবচম্পক- আভরণ।
কাছে এলে যবে হেরি অভিনব
ঘোর ঘননীল গুণ্ঠন তব,
চলচপলার চকিত চমকে
করিছে চরণ বিচরণ।
কোথা চম্পক- আভরণ!
সেদিন দেখেছি খনে খনে তুমি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে বনতল,
নুয়ে নুয়ে যেত ফুলদল।
শুনেছিনু যেন মৃদু রিনি রিনি
ক্ষীণ কটি ঘেরি বাজে কিংকিণী,
পেয়েছিনু যেন ছায়াপথে যেতে
তব নিশ্বাসপরিমল,
ছুঁয়ে যেতে যবে বনতল।
আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া
গগনে ছড়ায়ে এলোচুল,
চরণে জড়ায়ে বনফুল।
ঢেকেছে আমারে তোমার ছায়ায়
সঘন সজল বিশাল মায়ায়,
আকুল করেছ শ্যাম সমারোহে
হৃদয়সাগর- উপকূল
চরণে জড়ায়ে বনফুল।
ফাল্গুনে আমি ফুলবনে বসে
গেঁথেছিনু যত ফুলহার
সে নহে তোমার উপহার।
যেথা চলিয়াছ সেথা পিছে পিছে
স্তবগান তব আপনি ধ্বনিছে,
বাজাতে শেখে নি সে গানের সুর
এ ছোটো বীণার ক্ষীণ তার-
এ নহে তোমার উপহার।
কে জানিত সেই ক্ষণিকা মুরতি
দূরে করি দিবে বরষন,
মিলাবে চপল দরশন?
কে জানিত মোরে এত দিবে লাজ?
তোমার যোগ্য করি নাই সাজ,
বাসর- ঘরের দুয়ারে করালে
পূজার অর্ঘ্য- বিরচন-
একি রূপে দিলে দরশন।
ক্ষমা করো তবে ক্ষমা করো মোর
আয়োজনহীন পরমাদ,
ক্ষমা করো যত অপরাধ।
এই ক্ষণিকের পাতার কুটিরে
প্রদীপ- আলোকে এসো ধীরে ধীরে,
এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক
তব নয়নের পরসাদ-
ক্ষমা করো যত অপরাধ।
আস নাই তুমি নবফাল্গুনে
ছিনু যবে তব ভরসায়,
এসো এসো ভরা বরষায়।
এসো গো গগনে আঁচল লুটায়ে,
এসো গো সকল স্বপন ছুটায়ে,
এ পরান ভরি যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায়।
Kobi Guru Rabindranath Thakur Kobita গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে ৫ স্টার রেটিং দিতে ও শেয়ার করতে ভুলবেন না।