কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা গুলো হলো চাঁদিনি রাতে, তুমি মোরে ভুলিয়াছ, মিলন-মোহনায়, শীতের সিন্ধু ও চির-জনমের প্রিয়া। প্রেমিক কাজী নজরুলের আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচিত গান ও কবিতাতে। প্রেম-বিরহ, ব্যর্থতা, আশা, নিরাশার অনুভূতি প্রকাশে কাজী নজরুলের কোনো জুড়ি ছিল না৷ তাঁর প্রেমসংগীতগুলোর বাণী ও সুর এককথায় অনবদ্য ছিল।
কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা
কাজী নজরুল তাঁর জীবনে তিন হাজারেরও বেশি গান রচিত করেছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে ভক্তিমূলক গান, প্রকৃতি বন্দনা ও দেশাত্মবোধক গান, রয়েছে রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত সংগীত আর রণ সংগীত ইত্যাদি৷ কাজী নজরুল রচিত প্রণয়গীতিগুলো সে যুগে যেমন তেমনি আজও এখনকার তরুণ-তরুণীদের হৃদয়ে ঢেউ তোলে৷
নজরুলের প্রেমের কবিতা চাঁদিনি রাতে
কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে।
তৃতীয়া চাঁদের ‘সাম্পানে’ চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ-দরিয়া উতলা হল গো পুতলায় বুকে নিয়া।
নীলিম-প্রিয়ার নীলা গুল-রুখ নাজুক নেকাবে ঢাকা
দেখা যায় ওই নতুন চাঁদের কালোতে আবছা আঁকা।
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রানি,
‘লায়লা’-সেহেলি দিয়ে গেছে চুপে কুহেলি-মশারি টানি।
নীহার-নেটের ঝাপসা মশারি, যেন ‘বর্ডার’ তারই
দিক্-চক্রের ছায়া-ঘন ওই সবুজ তরুর সারি।
সাতাশ-তারার ফুল-তোড় হাতে আকাশে নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে।
‘উঁহু উঁহু’ করি কাঁচা ঘুম হতে জেগে ওঠে নীলা হুরি,
লুকায়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’ বলে হাসিছে পাপিয়া ছুঁড়ি।
‘মঙ্গল’ তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্র্রহর জাগে,
ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে, বুঝি বধূর নিশাস লাগে।
উল্কা-জ্বালার সন্ধানী আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী
‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করে ফেরে পায়চারি।
সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে,
‘হেথা হোথা ছোটে, পিকের কন্ঠে ফিক ফিক করে হাসে।
আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি
শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে, সখী!
নবমী চাঁদের ‘সংসারে’ ও কে গো চাঁদিনি-শিরাজি ঢালি
বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে, ‘তহুরা পিয়ো লো আলি!’
কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকি
চাঁদের সংসারে কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি!
মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালায় মিড়,
ফর্হাদ-শিরী লায়লি-মজনু মগজে করেছে ভিড়!
ছুটিতেছে গাড়ি, ছায়াবাজি-সম কত কথা ওঠে মনে,
দিশাহারা-সম ছোটে খ্যাপা মন জলে থলে নভে বনে!
এলোকেশে মোর জড়ায়ে চরণ কোন বিরহিণী কাঁদে,
যত প্রিয়-হারা আমারে কেন গো বাহু-বন্ধনে বাঁধে!
নিখিল বিরহী ফরিয়াদ করে আমার বুকের মাঝে,
আকাশে-বাতাসে তাদেরই মিলন তাদেরই বিরহ বাজে।
আনমনা সাকি, শূন্য আমার হৃদয়-পেয়ালা কোণে
কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখী লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে।
নজরুলের প্রেমের কবিতা pdf
নজরুলের প্রেমের কবিতা pdf ডাউনলোড করার জন্য নিচের দেওয়া ডাউনলোড বক্সে ক্লিক করুন।
নজরুলের প্রেমের কবিতা তুমি মোরে ভুলিয়াছ
তুমি মোরে ভুলিয়াছ তাই সত্য হোক! –
সেদিন যে জ্বলেছিল দীপালি-আলোক
তোমার দেউল জুড়ি – ভুল তাহা ভুল!
সেদিন ফুটিয়াছিল ভুল করে ফুল
তোমার অঙ্গনে প্রিয়! সেদিন সন্ধ্যায়
ভুলে পেরেছিলে ফুল নোটন-খোঁপায়!
ভুল করে তুলি ফুল গাঁথি বর-মালা
বেলাশেষে বারে বারে হয়েছ উতলা
হয়তো বা আর কারও লাগি!…আমি ভুলে
নিরুদ্দেশ তরি মোর তব উপকূলে
না চাহিতে বেঁধেছিনু, গেয়েছিনু গান,
নীলাভ তোমার আঁখি হয়েছিল ম্লান
হয়তো বা অকারণে! গোধূলি বেলায়
তোমার ও-আঁখিতলে! হয়তো তোমার
পড়ে মনে, কবে যেন কোন লোকে কার
বধূ ছিলে ; তারই কথা শুধু মনে পড়ে!
–ফিরে যাও অতীতের লোক-লোকান্তরে
এমনই সন্ধ্যায় বসি একাকিনী গেহে!
দুখানি আঁখির দীপ সুগভীর স্নেহে
জ্বালাইয়া থাক জাগি তারই পথ চাহি!
সে যেন আসিছে দূর তারা-লোক বাহি
পারাইয়া অসীমের অনন্ত জিজ্ঞাসা,
সে দেখেছে তব দীপ, ধরণির বাসা!
শাশ্বত প্রতীক্ষমানা অনন্ত সুন্দরী!
হায়, সেথা আমি কেন বাঁধিলাম তরি,
কেন গাহিলাম গান আপনা পাসারি?
হয়তো সে গান মম তোমার ব্যথায়
বেজেছিল। হয় তো বা লেগেছিল তার পায়
আমার তরির ঢেউ। দিয়াছিল ধুয়ে
চরণ-অলক্ত তব। হয়তো বা ছুঁয়ে
গিয়েছিল কপোলের আকুল কুন্তল
আমার বুকের শ্বাস। ও-মুখ-কমল
উঠেছিল রাঙা হয়ে। পদ্মের কেশর
ছুঁইলে দখিনা বায়, কাঁপে থরথর
যেমন কমল-দল ভঙ্গুর মৃণালে
সলাজ সংকোচে সুখে পল্লব-আড়ালে,
তেমনই ছোঁয়ায় মোর শিহরি শিহরি
উঠেছিল বারে বারে সারা দেহ ভরি!
চেয়েছিলে আঁখি তুলি, ডেকেছিল যেন
প্রিয় নাম ধরে মোর – তুমি জান, কেন!
তরি মম ভেসেছিল যে নয়ন-জলে
কূল ছাড়ি নেমে এলে সেই সে অতলে।
বলিলে,– “অজানা বন্ধু, তুমি কী গো সেই,
জ্বালি দীপ গাঁথি মালা যার আশাতেই
কূলে বসে একাকিনী যুগ যুগ ধরি
নেমে এসো বন্ধু মোর ঘাটে বাঁধ তরি!”
বিস্ময়ে রহিনু চাহি ও-মুখের পানে
কী যেন রহস্য তুমি – কী যেন কে জানে –
কিছুই বুঝিতে নারি! আহ্বানে তোমার
কেন জাগে অভিমান, জোয়ার দুর্বার
আমার আঁখির এই গঙ্গা যমুনায়!–
নিরুদ্দেশ যাত্রী, হায়, আসিলি কোথায়?
একি তোর ধেয়ানের সেই জাদুলোক,
কল্পনার ইন্দ্রপুরী? একি সেই চোখ
ধ্রুবতারাসম যাহা জ্বলে নিরন্তর
ঊর্ধ্বে তোর? সপ্তর্ষির অনন্ত বাসর?
কাব্যের অমরাবতী? একি সে ইন্দিরা,
তোরই সে কবিতা-লক্ষ্মী? –বিরহ-অধীরা
একি সেই মহাশ্বেতা, চন্দ্রপীড়-প্রিয়া?
উন্মাদ ফরহাদ যারে পাহাড় কাটিয়া
সৃজিতে চাহিয়াছিল – একি সেই শিঁরী?
লায়লি এই কি সেই, আসিয়াছে ফিরি
কায়েসের খোঁজে পুনঃ? কিছু নাহি জানি!
অসীম জিজ্ঞাসা শুধু করে কানাকানি
এপারে ওপারে, হায়!…তুমি তুলি আঁখি
কেবলই চাহিতেছিলে! দিনান্তের পাখি
বনান্তে কাঁদিতেছিল – ‘কথা কও বউ!’
ফাগুন ঝুরিতেছিল ফেলি ফুল-মউ!
কাহারে খুঁজিতেছিলে আমার এ চোখে
অবসান-গোধূলির মলিন আলোকে?
জিজ্ঞাসার, সন্দেহের শত আলো-ছায়া
ও-মুখে সৃজিতেছিল কী যেন কি মায়া!
কেবলই রহস্য হায়, রহস্য কেবল,
পার নাই সীমা নাই অগাধ অতল!
এ যেন স্বপনে-দেখা কবেকার মুখ,
এ যেন কেবলই সুখ কেবলই এ দুখ!
ইহারই স্ফুলিঙ্গ যেন হেরি রূপে রূপে,
এ যেন মন্দার-পুষ্প দেব-অলকায়!
যখন সবারে ভুলি। ধরার বন্ধন
যখন ছিঁড়িতে চাহি, স্বর্গের স্বপন
কেবলই ভুলাতে চায়, এই সে আসিয়া
রূপে রসে গন্ধে গানে কাঁদিয়া হাসিয়া
আঁকড়ি ধরিতে চাহে,–মাটির মমতা!
পরান-পোড়েনি শুধু, জানে নাকো কথা !
বুকে এর ভাষা নেই, চোখে নাই জল,
নির্বাক ইঙ্গিত শুদু শান্ত অচপল!
এ বুঝি গো ভাস্করের পাষাণ-মানসী
সুন্দর, কঠিন, শুভ্র। ভোরের ঊষসী,
দিনের আলোর তাপ সহিতে না জানে।
মাঠের উদাসী সুরে বাঁশরির তানে,
বাণী নাই, শুধু সুর, শুধু আকুলতা!
ভাষাহীন আবেদন দেহ-ভরা কথা।
এ যেন চেনার সাথে অচেনার মিশা, –
যত দেখি তত হায় বাড়ে শুধু তৃষা।
আসিয়া বসিলে কাছে দৃপ্ত মুক্তানন,
মনে হল – আমি দিঘি, তুমি পদ্মবন!
পূর্ণ হইলাম আজি, হয় হোক ভুল,
যত কাঁটা তত ফুল, কোথা এর তুল?
তোমারে ঘিরিয়া রব আমি কালো জল,
তরঙ্গের ঊর্ধ্বে রবে তুমি শতদল,
পুজারির পুষ্পাঞ্জলিসম। নিশিদিন
কাঁদিব ললাট হানি তীরে তৃপ্তিহীন!
তোমার মৃণাল-কাঁটা আমার পরানে
লুকায়ে রাখিব, যেন কেহ নাহি জানে।
…কত কী যে কহিলাম অর্থহীন কথা,
শত যুগ-যুগান্তের অন্তহীন ব্যথা।
শুনিলে সেসব জাগি বসিয়া শিয়রে,
বলিলে, “বন্ধু গো হের দীপ পুড়ে মরে
তিলে তিলে আমাদের সাথে! আর নিশি
নাই বুঝি, দিবা এলে দূরে যাব মিশি!
আমি শুধু নিশীথের।” যখন ধরণি
নীলিমা-মঞ্জুষা খুলি হেরে মুক্তামণি
বিচিত্র নক্ষত্রমালা – চন্দ্র-দীপ জ্বালি,
একাকী পাপিয়া কাঁদে ‘চোখ গেল’খালি,
আমি সেই নিশিথের। – আমি কই কথা,
যবে শুধু ফোটে ফুল, বিশ্ব তন্দ্রাহতা।
হয়তো দিবসে এলে নারিব চিনিতে,
তোমারে করিব হেলা, তব ব্যথা-গীতে
কেবলই পাইবে হাসি সবার সুমুখে,
কাঁদিলে হাসিব আমি সরল কৌতুকে,
মুছাব না আঁখি-জল। বলিব সবায়,
“তুমি শাঙনের মেঘ –যথায় তথায়
কেবলই কাঁদিয়া ফের, কাঁদাই স্বভাব!
আমি তো কেতকী নহি, আমার কি লাভ
ওই শাঙনের জলে? কদম্ব যূথীর
সখারে চাহি না আমি। শ্বেত-করবীর
সখী আমি। হেমন্তের সান্ধ্য-কুহেলিতে
দাঁড়াই দিগন্তে আসি, নিরশ্রু-সংগীতে
ভরে ওঠে দশ দিক! আমি উদাসিনী।
মুসাফির! তোমারে তো আমি নাহি চিনি!”
ডাকিয়া উঠিল পিক দূরে আম্রবনে
মুহুমুহু কুহুকুহু আকুল নিঃস্বনে।
কাঁদিয়া কহিনু আমি, “শুন, সখী শুন,
কাতরে ডাকিছে পাখি কেন পুনঃ পুনঃ!
চলে যাব কোন দূরে, স্বরগের পাখি
তাই বুঝি কেঁদে ওঠে হেন থাকি থাকি।
তোমারই কাজল আঁখি বেড়ায় উড়িয়া,
পাখি নয় – তব আঁখি ওই কোয়েলিয়া!”
হাসিয়া আমার বুকে পড়িলে লুটায়ে,
বলিলে, –“পোড়ারমুখি আম্রবনচ্ছায়ে
দিবানিশি ডাকে, শুনে কান ঝালাপালা!
জানি না তো কুহু-স্বরে বুকে ধরে জ্বালা!
উহার স্বভাব এই, তোমারই মতন
অকারণে গাহে গান, করে জ্বালাতন!
নিশি না পোহাতে বসি বাতায়ন-পাশে
হলুদ-চাঁপার ডালে, কেবলই বাতাসে
উহু উহু উহু করি বেদনা জানায়!
বুঝিতে নারিনু আমি পাখি ও তোমায়!”
নয়নের জল মোর গেল তলাইয়া
বুকের পাষাণ-তলে। উৎসারিত হিয়া
সহসা হারাল ধারা তপ্ত মরু-মাঝে।
আপনারে অভিশাপি ক্ষমাহীন লাজে!
কহিনু, “কে তুমি নারী, এ কি তব খেলা?
অকারণে কেন মোর ডুবাইলে ভেলা,
এ অশ্রু-পাথারে একা দিলে ভাসাইয়া?
দুহাতে আন্দোলি জল কূলে দাঁড়াইয়া,
অকরুণা, হাস আর দাও করতালি!
অদূরে নৌবতে বাজে ইমন-ভূপালি
তোমার তোরণ-দ্বারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
– তোমার বিবাহ বুঝি? ওই বাঁশুরিয়া
ডাকিছে বন্ধুরে তব?” যুঝি ঢেউ সনে
শুধানু পরান-পণে।…তুমি আনমনে
বারেক পশ্চাতে চাহি পড়িলে লুটায়ে
স্রোতজলে, সাঁতরিয়া আসি মম পাশে
‘আমিও ডুবিব সাথে’বলিয়া তরাসে
জড়ায়ে ধরিলে মোরে বাহুর বন্ধনে!…
হইলাম অচেতন!… কিছু নাই মনে
কেমনে উঠিনু কূলে!… কবে সে কখন
জড়াইয়া ধরেছিলে মালার মতন
নিশীথে পাথার-জলে, – শুধু এইটুকু
সুখ-স্মৃতি ব্যথা সম চির-জাগরূক
রহিল বুকের তলে!… আর কিছু নাই!…
তোমারে খুঁজিয়া ফিরি এ কূলে বৃথাই,
হে চীর রহস্যময়ী!ও কূলে দাঁড়ায়ে
তেমনই হাসিছ তুমি সান্ধ্য-বনচ্ছায়ে
চাহিয়া আমার মুখে! তোমার নয়ন
বলিছে সদাই যেন, ‘ডুবিয়া মরণ
এবার হল না, সখা! আজও যায় সাধ
বাঁচিতে ধরার পরে। স্বপনের চাঁদ
হয়তো বা দিবে ধরা জাগ্রত এলোকে,
হয়তো নামিবে তুমি অশ্রু হয়ে চোখে,
আসিবে পথিক-বন্ধু হয়ে প্রিয়তম
বুকের ব্যাথায় মোর – পুষ্পে গন্ধ সম!
অঞ্জলি হইতে নামি তোমার পূজার
জড়াইয়া রব বক্ষে হয়ে কণ্ঠহার!’
নিশীথের বুক-চেরা তব সেই স্বর,
সেই মুখ সেই চোখ করুণা-কাতর
পদ্মা-তীরে-তীরে রাতে আজও খুঁজে ফিরি!
কত নামে ডাকি তোমা, – “মহাশ্বেতা, শিঁরী,
লায়লি, বকৌলি, তাজ, দেবী, নারী, প্রিয়া!”
– সাড়া নাহি মিলে কারও! ফুলিয়া ফুলিয়া
বয়ে যায় মেঘনার তরঙ্গ বিপুল,
কখনও এ-কূল ভাঙে কখনও ও-কূল!
পার হতে নারি এই তরঙ্গের বাধা,
ও যেন ‘এসো না’ বলে পায়ে ধরে-কাঁদা
তোমার নয়ন-স্রোত! ও যেন নিষেধ,
বিধাতার অভিশাপ, অনন্ত বিচ্ছেদ,
স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে যেন যবনিকা!…
আমাদের ভাগ্যে বুঝি চিররাত্রি লিখা!
নিশীথের চখাচখি, দুইপারে থাকি
দুইজনে দুইজন ফিরি সদা ডাকি!
কোথা তুমি? তুমি কোথা? যেন মনে লাগে,
কত যুগ দেখি নাই! কত জন্ম আগে
তোমারে দেখেছি কোন নদীকূলে গেহে,
জ্বালো দীপ বিষাদিনী ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে!
বারে বারে কাঁপে, আকাশ-দীপিকা
কাঁপে তারারাজি – যেন আঁখি-পাতা তব,–
এইটুকু পড়ে মনে! কবে অভিনব
উঠিলে বিকশি তুমি আমার মাঝে,
দেখি নাই! দেখিব না – কত বিনা কাজে
নিজেরে আড়াল করি রাখিছ সতত
অপ্রকাশ সুগোপন বেদনার মতো।
আমি হেথা কূলে কূলে ফিরি আর কাঁদি,
কুড়ায়ে পাব না কিছু? বুকে যাহা বাঁধি
তোমার পরশ পাব – একটু সান্ত্বনা!
চরণ-অলক্ত-রাঙা দুটি বালুকণা,
একটি নূপুর, ম্লান বেণি-খসা ফুল,
করবীর সোঁদা-ঘষা পরিমল-ধুল,
আধখানি ভাঙা চুড়ি রেশমি কাচের,
দলিত বিশুষ্ক মালা নিশি-প্রভাতের,
তব হাতে লেখা মম প্রিয় ডাক-নাম
লিখিয়া ছিঁড়িয়া-ফেলা আধখানি খাম,
অঙ্গের সুরভি-মাখা ত্যক্ত তপ্ত বাস,
মহুয়ার মদ সম মদির নিশ্বাস
পুরবের পরিস্থান হতে ভেসে-আসা, –
কিছুই পাব না খুঁজি? কেবলই দুরাশা।
কাঁদিবে পরান ঘিরি? নিরুদ্দেশ পানে
কেবলই ভাসিয়া যাব শ্রান্ত ভাটি-টানে?
তুমি বসি রবে ঊর্ধ্বে মহিম-শিখরে
নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে
নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে
নামিবে না প্রিয়া-রূপে ধরার ধুলায়?
লো কৌতুকময়ী! শুধু কৌতুক-লীলায়
খেলিবে আমারে লয়ে? –আর সবই ভুল?
ভুল করে ফুটেছিল আঙিনায় ফুল?
ভুল করে বলেছিলে সুন্দর? অমনি –
ঢেকেছ দুহাতে মুখ ত্বরিতে তখনই!
বুঝি কেহ শুনিয়াছে, দেখিয়াছে কেহ
ভাবিয়া আঁধার কোণে লীলায়িত দেহ
লুকাওনি সুখে লাজে? কোন শাড়িখানি
পরেছিলে বাছি বাছি সে সন্ধ্যায় রানি?
হয়তো ভুলেছ তুমি, আমি ভুলি নাই!
যত ভাবি ভুল তাহা – তত সে জড়াই
সে ভুলে সাপিনিসম বুকে ও গলায়!
বাসি লাগে ফুলমেলা। – ভুলের খেলায়
এবার খোয়াব সব, করিয়াছি পণ।
হোক ভুল, হোক মিথ্যা, হোক এ স্বপন,
–এইবার আপনারে শূন্য রিক্ত করি
দিয়া যাব মরণের আগে! পাত্র ভরি
করে যাব সুন্দরের করে বিষপান!
তোমারে অমর করি করিব প্রয়াণ
মরণের তীর্থযাত্রী!
ওগো, বন্ধু প্রিয়,
এমনই করিয়া ভুল দিয়া ভুলাইয়ো
বারে বারে জন্মে জন্মে গ্রহে গ্রহান্তরে!
ও-আঁখি-আলোক যেন ভুল করে পড়ে
আমার আঁখির পরে। গোধূলি-লগনে
ভুল করে হই বর, তুমি হও কনে
ক্ষণিকের লীলা লাগি! ক্ষণিকের চমকি
অশ্রুর শ্রাবণ-মেঘে হারাইয়া সখী!…
তুমি মোরে ভুলিয়াছ, তাই সত্য হোক!
নিশি-শেষে নিভে গেছে দীপালি-আলোক!
সুন্দর কঠিন তুমি পরশ-পাথর
তোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর –
– তুমি তাহা জানিলে না!
…সত্য হোক প্রিয়া
দীপালি জ্বলিয়াছিল – গিয়াছে নিভিয়া!
নজরুলের প্রেমের কবিতা মিলন-মোহনায়
হায় হাবা মেয়ে, সব ভুলে গেলি দয়িতের কাছে এসে!
এত অভিমান এত ক্রন্দন সব গেল জলে ভেসে !
কূলে কূলে এত ভুলে ফুলে কাঁদা আছড়ি পিছাড়ি তোর,
সব ফুলে গেলি যেই বুকে তোরে টেনে নিল মনোচোর!
সিন্ধুর বুকে লুকাইলি মুখ এমনই নিবিড় করে,
এমনই করিয়া হারাইলি তুই আপনারে চিরতরে –
যে দিকে তাকাই নাই তুই নাই! তোর বন্ধুর বাহু
গ্রাসিয়াছে তোরে বুকের পাঁজরে – ক্ষুধাতুর কাল রাহু!
বিরহের কূলে অভিমান যার এমন ফেনায়ে উঠে,
মিলনের মুখে সে ফিরে এমনই পদতলে পড়ে লুটে?
এমনই করিয়া ভাঙিয়া পড়ে কি বুক-ভাঙা কান্নায়,
বুকে বুক রেখে নিবিড় বাঁধনে পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়?
তোর বন্ধুর আঙুলের ছোঁয়া এমনই কি জাদু জানে,
আবেশে গলিয়া অধর তুলিয়া ধরিলি অধর পানে!
একটি চুমায় মিটে গেল তোর সব সাধ সব তৃষা,
ছিন্ন লতার মতন মুরছি পড়িলি হারায়ে দিশা!
– একটি চুমার লাগি
এতদিন ধরে এত পথ বেয়ে এলি বেয়ে এলি কি রে হতভাগি?
গাঙ-চিল আর সাগর-কপোত মাছ ধরিবার ছলে,
নিলাজি লো, তোর রঙ্গ দেখিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে।
দুধারের চর অবাক হইয়া চেয়ে আছে তোর মুখে,
সবার সামনে লুকাইলি মুখ কেমনে বঁধুর বুকে?
নীলিম আকাশে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মেঘের গুণ্ঠন ফেলে
বউ-ঝির মতো উঁকি দিয়ে দেখে কুতূহলী-আঁখি মেলে।
‘সাম্পান’-মাঝি খুঁজে ফেরে তোর ভাটিয়ালি গানে কাঁদি,
খুঁজিয়া নাকাল দুধারের খাল – তোর হেরেমের বাঁদি!
হায় ভিখারিনি মেয়ে,
ভুলিলি সবারে, ভুলিলি আপনা দয়িতেরে বুকে পেয়ে!
তোরই মতো নদী আমি নিরবধি কাঁদি রে প্রীতম লাগি,
জন্ম-শিখর বাহিয়া চলেছি তাহারই মিলন মাগি!
যার তরে কাঁদি – ধার করে তারই জোয়ারের লোনা জল
তোর মতো মোর জাগে না রে কভু সাধের কাঁদন-ছল।
আমার অশ্রু একাকী আমার, হয়তো গোপনে রাতে
কাঁদিয়া ভাসাই, ভেসে ভেসে যাই মিলনের মোহানাতে,
আসিয়া সেথায় পুনঃ ফিরে যাই। – তোর মতো সব ভুলে
লুটায়ে পড়ি না – চাহে না যে মোরে তারই রাঙ্গা পদমূলে!
যারে চাই তারে কেবলই এড়াই কেবলই দি তারে ফাঁকি ;
সে যদি ভুলিয়া আঁখি পানে চায় ফিরাইয়া লই আঁখি!
–তার তীরে যবে আসি
অশ্রু-উৎসে পাষাণ চাপিয়া অকারণে শুধু হাসি!
অভিমানে মোর আঁখিজল জমে করকা-বৃষ্টি সম,
যারে চাই তারে আঘাত হানিয়া ফিরে যায় নির্মম!
একা মোর প্রেম ছুটিবে কেবলই নিচু প্রান্তর বেয়ে,
সে কভু ঊর্ধ্বে আসিবে না উঠে আমার পরশ চেয়ে –
চাহি না তাহারে! বুকে চাপা থাকা আমার বুকের ব্যথা,
যে বুক শূন্য নহে মোরে চাহি – হব নাকো ভার সেথা!
সে যদি না ডাকে কী হবে ডুবিয়া ও-গভীর কালো নীরে,
সে হউক সুখী, আমি রচে যাই স্মৃতি-তাজ তার তীরে!
মোর বেদনার মুখে চাপিয়াছি নিতি যে পাষাণ-ভার!
তা দিয়ে রচিব পাষাণ-দেউল সে পাষাণ-দেবতার!
কত স্রোতধারা হারাইছে কূল তার জলে নিরবধি,
আমি হারালাম বালুচরে তার, গোপন-ফাল্গুনদী!
নজরুলের প্রেমের কবিতা শীতের সিন্ধু
ভুলি নাই পুনঃ তাই আসিয়াছি ফিরে
ওগো বন্ধু, ওগো প্রিয়, তব সেই তীরে!
কূল-হারা কূলে তব নিমেষের লাগি
খেলিতে আসিয়া হায় যে কবি বিবাগি
সকলই হারায়ে গেল তব বালুচরে, –
ঝিনুক কুড়াতে এসে – গেল আঁখি ভরে
তব লোনা জল লয়ে, –তব স্রোত-টানে
ভাসিয়া যে গেল দূর নিরুদ্দেশে পানে!
ফিরে সে এসেছে আজ বহু বর্ষ পরে,
চিনিতে পার কি বন্ধু, মনে তারে পড়ে?
বর্ষার জোয়ারে যারে তব হিন্দোলায়
দোলাইয়া ফেলে দিলে দুরাশা-সীমায়,
ফিরিয়া সে আসিয়াছে তব ভাটি-মুখে,
টানিয়া লবে কি আজ তারে তব বুকে?
খেলিতে আসিনি বন্ধু, এসেছি এবার
দেখিতে তোমার রূপ বিরহ-বিথার।
সেবার আসিয়াছিনু হয়ে কুতূহলী,
বলিতে আসিয়া – দিনু আপনারে বলি
কৃপণের সম আজ আসিয়াছি ফিরে
হারায়েছি মণি যথা সেই সিন্ধু-তীরে!
ফেরে না তা যা হারায় – মণি-হারা ফণী
তবু ফিরে ফিরে আসে! বন্ধু গো, তেমনি
হয়তো এসেছি বৃথা চোর বালুচরে!–
যে চিতা জ্বলিয়া, –যায় নিভে চিরতরে,
পোড়া মানুষের মন সে মহাশ্মাশানে
তবু ঘুরে মরে কেন, –কেন সে কে জানে!
প্রভাতে ঢাকিয়া আসি কবরের তলে
তারি লাগি আধ-রাতে অভিসারে চলে
অবুঝ মানুষ, হায়! – ওগো উদাসীন,
সে বেদনা বুঝবে না তুমি কোনোদিন!
হয়তো হারানো মণি ফিরে তারা পায়,
কিন্তু হায়, যে অভাগা হৃদয় হারায়
হারায়ে সে চিরতরে! এ জনমে তার
দিশা নাহি মিলে, বন্ধু! – তুমি পারাবার,
পারাপার নাহি তব, তোমার অতলে
যা ডোবে তা চিরতরে ডোবে আঁখিজলে!
জানিলে সাঁতার, বন্ধু, হইলে ডুবুরি,
করিতাম কবে তব বক্ষ হতে চুরি
রত্নহার! কিন্তু হায় জিনে শুধু মালা
কী হইবে বাড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা!
বন্ধু, তব রত্নহার মোর তরে নয় –
মালার সহিত যদি না মেলে হৃদয়!
হে উদাসী বন্ধু মোর, চির আত্মভোলা,
আজি নাই বুকে তব বর্ষার হিন্দোলা!
শীতের কুহেলি-ঢাকা বিষণ্ণ বয়ানে
কীসের করুণা মাখা! কূলের সিথানে
এলায়ে শিথিল দেহ আছ একা শুয়ে,
বিশীর্ণ কপোল বালু-উপাধানে থুয়ে!
তোমার কলঙ্কী বঁধু চাঁদ ডুবে যায়
তেমনই উঠিয়া দূর গগন-সীমায়,
ছায়া এসে পড়ে তার তোমার মুকুরে,
কায়াহীন মায়াবীর মায়া বুকে পূরে
ফুলে ফুলে কূলে কূলে কাঁদ অভিমানে,
আছাড়ি তরঙ্গ-বাহু ব্যর্থ শূন্য পানে!
যে কলঙ্কী নিশিদিন ধায় শূন্য পথে –
সে দেখে না, কোথা, কোন বাতায়ন হতে,
কে তারে চাহিয়াছে নিতি! সে খুঁজে বেড়ায়
বুকের প্রিয়ারে ত্যজি পথের প্রিয়ায়!
ভয় নাই বন্ধু ওগো, আসিনি জানিতে
অন্ত তব, পেতে ঠাঁই অন্তহীন চিতে!
চাঁদ না সে চিতা জ্বলে তব উপকূলে –
কে কবে ডুবিয়া হায়, পাইয়াছে তল?
এক ভাগ থল সেথা, তিন ভাগ জল!
এসেছি দেখিতে তারে সেদিন বর্ষায়
খেলিতে দেখেছি যারে উদ্দাম লীলায়
বিচিত্র তরঙ্গ-ভঙ্গে! সেদিন শ্রাবণে
ছলছল জল-চুড়ি-বলয়-কঙ্কণে
শুনিয়াছি যে-সঙ্গীত, যার তালে তালে
নেচেছে বিজলি মেঘে, শিখী নীপ-ডালে।
যার লোভে অতি দূর অস্তদেশ হতে
ছুটে এসেছিনু এই উদয়ের পথে! –
ওগো মোর লীলা-সাথি অতীত বর্ষার,
আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার!
চলে গেছে আজি সেই বরষার মেঘ,
আকাশের চোখে নাই অশ্রুর উদ্বেগ,
গরজে না গুর গুর গগনে সে বাজ,
উড়ে গেছে দূর বনে ময়ূরীরা আজ,
রোয়ে রোয়ে বহে নাকো পুবালি বাতাস,
শ্বসে না ঝাউয়ের শাখে সেই দীর্ঘশ্বাস,
নাই সেই চেয়ে-থাকা বাতায়ন খুলি
সেই পথে – মেঘ যথা যায় পথ ভুলি।
না মানিয়া কাজলের ছলনা নিষেধ
চোখ ছেপে জল ঝরা, –কপোলের স্বেদ
মুছিবার ছলে আঁখি-জল মোছা সেই,
নেই বন্ধু, আজি তার স্মৃতিও সে নেই!
থর থর কাঁপে আজ শীতের বাতাস,
সেদিন আশার ছিল যে দীরঘ-শ্বাস –
আজ তাহা নিরাশায় কেঁদে বলে, হায় –
“ওরে মূঢ়, যে চায় সে চিরতরে যায়!
যাহারে রাখিবি তুই অন্তরের তলে
সে যদি হারায় কভু সাগরের জলে
কে তাহারে ফিরে পায়? নাই, ওরে নাই,
অকূলের কূলে তারে খুঁজিস বৃথাই!
যে-ফুল ফোটেনি ওরে তোর উপবনে
পুবালি হাওয়ার শ্বাসে বরষা-কাঁদনে,
সে ফুল ফুটিবে না রে আজ শীত-রাতে
দু ফোঁটা শিশির আর অশ্রুজল-পাতে!”
আমার সান্ত্বনা নাই জানি বন্ধু জানি,
শুনিতে এসেছি তবু – যদি কানাকানি
হয় তব কূলে কূলে আমার সে ডাক!
এ কূলে বিরহ-রাতে কাঁদে চক্রবাক,
ও কূলে শোনে কি তাহা চক্রবাকী তার?
এ বিরহ একি শুধু বিরহ একার?
কুহেলি-গুণ্ঠন টানি শীতের নিশীথে
ঘুমাও একাকী যবে, নিশব্দ সংগীতে
ভরে ওঠে দশ দিক, সে নিশীথে জাগি
ব্যথিয়া ওঠে না বুক কভু কাও লাগি?
গুণ্ঠন খুলিয়া কভু সেই আধরাতে
ফিরিয়া চাহ না তব কূলে কল্পনাতে?
চাঁদ সে তো আকাশের, এই ধরা-কূলে
যে চাহে তোমায় তারে চাহ না কি ভুলে?
তব তীরে অগস্ত্যের সম লয়ে তৃষা
বসে আছি, চলে যায় কত দিবা-নিশা!
যাহারে করিতে পারি চুমুকেতে পান
তার পদতলে বসি গাহি শুধু গান!
জানি বন্ধু, এ ধরার মৃৎপাত্রখানি
ভরিতে নারিল যাহা – তারে আমি আনি
ধরিব না এ অধরে! এ মম হিয়ার
বিপুল শূন্যতা তাহে নহে ভরিবার!
আসিয়াছি কূলে আজ, কাল প্রাতে ঝুরে
কূল ছাড়ি চলে যাব দূরে বহুদূরে।
বলো বন্ধু, বলো, জয় বেদনার জয়!
যে-বিরহে কূলে কূলে নাহি পরিচয়,
কেবলই অনন্ত জল অনন্ত বিচ্ছেদ,
হৃদয় কেবলই হানে হৃদয়ে নিষেধ ;
যে-বিরহে গ্রহ-তারা শূন্যে নিশিদিন
ঘুরে মরে ; গৃহবাসী হয়ে উদাসীন –
উল্কা-সম ছুটে যায় অসীমের পথে,
ছোটে নদী দিশাহারা গিরিচূড়া হতে ;
বারে বারে ফোটে ফুল কণ্টক-শাখায়,
বারে বারে ছিঁড়ে যায় তবু না ফুরায়
মালা-গাঁথা যে-বিরহে, যে-বিরহে জাগে
চকোরী আকাশে আর কুমুদী তড়াগে ;
তব বুকে লাগে নিতি জোয়ারের টান,
যে-বিষ পিইয়া কণ্ঠে ফুটে ওঠে গান –
বন্ধু, তার জয় হোক! এই দুঃখ চাহি
হয়তো আসিব পুনঃ তব কূল বাহি।
হেরিব নতুন রূপে তোমারে আবার,
গাহিব নতুন গান। নব অশ্রুহার
গাঁথিব গোপনে বসি। নয়নের ঝারি
বোঝাই করিয়া দিব তব তীরে ডারি।
হয়তো বসন্তে পুনঃ তব তীরে তীরে
ফুটিবে মঞ্জরি নব শুষ্ক তরু-শিরে।
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,
যেদিন ও বুকে তব শুকাইবে জল,
নিদারুণ রৌদ্র-দাহে ধুধু মরুতল
পুড়িবে একাকী তুমি মরূদ্যান হয়ে
আসবি সেদিন বন্ধু, মম প্রেম লয়ে!
আঁখির দিগন্তে মোর কুহেলি ঘনায়,
বিদায়ের বংশী বাজে, বন্ধু গো বিদায়!
নজরুলের প্রেমের কবিতা চির-জনমের প্রিয়া
আরও কতদিন বাকি?
বক্ষে পাওয়ার আগে বুঝি, হায়, নিভে যায় মোর আঁখি!
অনন্তলোকে অনন্তরূপে কেঁদেছি তোমার লাগি
সেই আঁখিগুলি তারা হয়ে আজও আকাশে রয়েছে জাগি।
চির-জনমের প্রিয়া মোর! চেয়ে দেখো নীলাকাশে
ভ্রমরের মতো ঝাঁক বেঁধে কোটি গ্রহ-তারা ছুটে আসে
তোমার শ্রীমুখ-কমলের পানে! ওরা যে ভুলিতে নারে
আজিও খুঁজিয়া ফিরিছে তোমায় অসীম অন্ধকারে!
বারে বারে মোর জীবন-প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে, প্রিয়া।
নেভেনি আমার নয়ন, তোমারে দেখিবার আশা নিয়া।
আমি মরিয়াছি, মরেনি নয়ন ; দেখো প্রিয়তমা চাহি
তব নাম লয়ে ওরা কাঁদে আজও – ওদের নিদ্রা নাহি।
ওরা তারা নয়, অভিশপ্ত এ বিরহীর ওরা আঁখি,
মহাব্যোম জুড়ে উড়িয়া বেড়ায় আশ্রয়হারা পাখি!
আঁখির আমার ভাগ্য ভালো গো, পেয়েছিল আঁখি-জল,
তাই আজও তারা অমর হইয়া ভরে আছে নভোতল!
বাহু দিয়া মোর কন্ঠ যদি গো জড়াইতে কোনদিন,
আঁখির মতন এই দেহ মোর হইত মৃত্যুহীন!
তোমার অধর নিঙাড়িয়া মধু পান করিতাম যদি,
আমার কাব্যে, সংগীতে, সুরে বহিত অমৃত-নদী!
ফুল কেন এত ভালো লাগে তব, কারণ জান কি তার?
ওরা যে আমার কোটি জনমের ছিন্ন অশ্রুহার!
যত লোকে আমি তোমার বিরহে ফেলেছি অশ্রুজল,
ফুল হয়ে সেই অশ্রু – ছুঁইতে চাহে তব পদতল!
অশ্রুতে মোর গভীর গোপন অভিমান ছিল হায়,
তাই অভিমানে তোমারে ছুঁইয়া ফুল শুকাইয়া যায়!
ঝরা ফুল লয়ে বক্ষে জড়ায়ে ধরেছ কি কোনোদিন?
এত সুন্দর, তবু কেন ফুল এমন ব্যথা-মলিন?
তব মুখ পানে চেয়ে থাকে ফুল মোর অশ্রুর মতো;
তোমারে হেরিয়া উহাদের গত জনমের স্মৃতি যত
জেগে ওঠে প্রাণে! তাই অভিমানে ঝরে সে সন্ধ্যাবেলা,
ভুলিতে পারে না, যুগে যুগে তুমি হানিয়াছ যত হেলা!
পূর্ণিমা চাঁদ দেখেছ? দেখেছ তার বুকে কালো দাগ!
ওর বুকে ক্ষত-চিহ্ন এঁকেছে, জান, কার অনুরাগ?
কোটি জনমের অপূর্ণ মোর সাধ-আশা জমে জমে
চাঁদ হয়ে হায় ভাসিয়া বেড়ায় নিরাশার মহাব্যোমে!
কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে তার তোমার স্মৃতির ছায়া,
এত জ্যোৎস্নায় ঢাকিতে পারেনি তোমার মধু মায়া!
কোন সে অতীতে মহাসিন্ধুর মন্থন শেষে, প্রিয়া,
বেদনা-সাগরে চাঁদ হয়ে উঠে তোমারে বক্ষে নিয়া!
পালাইতে ছিনু সুদূর শূন্যে! নিঠুর বিধাতা পথে
তোমারে ছিনিয়া লয়ে গেল হায় আমার বক্ষ হতে!
তুমি চলে গেলে, বুকে রয়ে গেল তব অঙ্গের ছাপ,
শূন্য বক্ষে শূন্যে ঘুরি গো, চাঁদ নয় অভিশাপ!
প্রাণহীন দেহ আকাশে ফেলিয়া ধরণিতে আসি ফিরে,
তোমারে খুঁজিয়া বেড়াই গোমতী পদ্মা যমুনা তীরে!
চিনি যবে হায় গোধূলিবেলায় শুভ লগ্নের ক্ষণে,
বাঁশি না বাজিতে লগ্ন ফুরায়, আঁধার ঘনায় বনে!
তুমি চলো যাও ভবনের বধূ, আমি যাই বনপথে,
মোর জীবনের মরা ফুল তুলে দিই মরণের রথে!
শ্রাবণ-নিশীথে ঝড়ের কাঁদন শুনেছ কি কোনোদিন?
কার অশান্ত অসহ রোদন আজও শ্রান্তহীন
দিগ্দিগন্তে দস্যুর মতো হানা দিয়ে ফেরে হায়!
ভবনে ভবনে কার বুক থেকে কাহারে ছিনিতে চায়? –
এমনই সেদিন উঠেছিল ঝড় মহাপ্রলয়ের বেশে
যেদিন আমারে পথে ফেলে গেলে চলিয়া নিরুদ্দেশে!
প্রবল হস্তে নাড়া দিয়া আমি অসীম শূন্য নভে
কৃষ্ণ মেঘের ঢেউ তুলেছিনু ; গর্জিয়া ভীম রবে
বিশ্বের ঘুম ভেঙে দিয়েছিনু! যেখানে যে ছিল সুখে
যেখানে প্রিয় ও প্রিয়া ছিল – সেথা বজ্র হেনেছি বুকে!
ঝড়ের বাতাসে আমার নিশাসে নড়িল না মহাকাল,
মোর ধূমায়িত অশ্রু-বাষ্প রচিল জলদ-জাল।
অঝোর ধারায় ঝরিনু ধরায় খুঁজিলাম বনভূমি
ফুরাইল আয়ু, থির হল বায়ু, সাড়া দিলে নাকো তুমি!
আমার ক্ষুধিত সেই প্রেম আজও বিজলি-প্রদীপ জ্বেলে
অন্ধ আকাশ হাতড়িয়া ফেরে ঝঞ্ঝার পাখা মেলে!
তুমি বেঁচে গেছ, অতীতের স্মৃতি ভুলিয়াছ একেবারে,
নইলে ভুলিয়া ভয় – ছুটে যেতে মরণের অভিসারে!
শান্ত হইনু প্রলয়ের ঝড়, মলয়-সমীর রূপে
যেখানে দেখেছি ফুল সেইখানে ছুটে গেছি চুপে চুপে।
পৃথিবীতে যত ফুটিয়াছে ফুল সকল ফুলের মুখে
তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি – না পেয়ে উগ্র দুখে
ঝরায়েছি ফুল ধরার ধুলায়! জরা ফুল-রেণু মেখে
উদাসীন হাওয়া ফিরিয়াছি পথে তব প্রিয় নাম ডেকে!
সদ্য-স্নাতা এল কুন্তল শুকাইতে যবে তুমি
সেই এলোকেশ বক্ষে জড়ায়ে গোপনে যেতাম চুমি!
তোমার কেশের সুরভি লইয়া দিয়াছি ফুলের বুকে
আঁচল ছুঁইয়া মূর্ছিত হয়ে পড়েছি পরম সুখে!
তোমার মুখের মদির সুরভি পিইয়া নেশায় মাতি
মহুয়া বকুল বনে কাটায়েছি চৈতি চাঁদিনি রাতি।
তব হাত দুটি লতায়ে রহিত পুষ্পিতা লতা সম
কত সাধ যেত যদি গো জড়াত ও লতা কন্ঠে মম!
তব কঙ্কণ চুড়ি লয়ে আমি খেলেছি, দেখনি তুমি,
চলিতে মাথার কাঁটা পড়ে যেত, আমি তুলিতাম চুমি!
চোরের মতন চুরি করিয়াছি তব কবরীর ফুল!–
সে সব অতীত জনমের কথা – আজ মনে হয় ভুল!
আজ মুখপানে চেয়ে দেখি, তব মুখে সেই মধু আছে,
আজও বিরহের ছায়া দোলে তব চোখের কোলের কাছে!
ডাগর নয়নে আজও পড়ে সেই সাগর জলের ছায়া,
তনুর অণুতে অণুতে আজিও সেই অপরূপ মায়া!
আজও মোর পানে চাহ যবে, বুকে ঘন শিহরন জাগে,
আমার হৃদয়ে কোটি শতদল ফুটে ওঠে অনুরাগে
আজও যবে চাও, আমার ভুবনে ওঠে রোদনের বাণী,
কানাকানি করে চাঁদে ও তারাতে –‘জানি গো তোমারে জানি!’
রুধিরে আমার নূপুর বাজে গো, কহে – ‘প্রিয়া, চিনি, চিনি’!
একদিন ছিলে প্রেমের গোলোকে মোর প্রেম-গরবিনি।
ছিল একদিন – আমার সোহাগে গলিয়া যমুনা হতে
নিবেদিত নীল পদ্মের মতো ভাসিতে প্রেমের স্রোতে!
ভাসিতে ভাসিতে আসিয়াছ আজ এই পৃথিবীর ঘাটে,
আমি পুষ্প-বিহীন শূন্যবৃন্ত কাঁটা লয়ে দিন কাটে!
মনে করো, যেন সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা।
তুমি রয়ে গেলে এপারে, ভাসিল ওপারে আমার ভেলা!
সেই নদীজলে পড়ে গেলে তুমি ফুলের মতন ঝরে,
কেঁদে বলেছিলে যাবার বেলায় – ‘মনে কি পড়িবে মোরে,
জনমিবে যবে আর কি আঁকিবে হৃদয়ে আমার ছবি।’
আমি বলেছিনু, ‘উত্তর দেবে আর জনমের কবি!’
সেই বিরহীর প্রতিশ্রুতি গো আসিয়াছি কবি হয়ে,
ছবি আঁকি তব আমার বুকের রক্ত ও আয়ু লয়ে!
ঝাঁকে ঝাঁকে মোর কথার কপোত দিকে দিকে যায় ছুটে
হংস-দূতীর মতো মোর লিপি ধরিয়া চঞ্চুপুটে!
হারায়ে গিয়াছে শূন্যে তাহারা ফিরিয়া আসেনি আর,
তাই সুরে সুরে বিধূনিত করি অসীম অন্ধকার!
ভবনে ভবনে সেই সুর প্রতি কন্ঠ জড়ায়ে কহে–
‘যাহারে খুঁজিয়া কাঁদি নিশিদিন, জান সে কোথায় রহে?’
তারা মরে, ফুল ঝরে সেই সুরে, তুমি শুধু কাঁদিলে না
আমার সুরের পালক কুড়ায়ে কবরীতে বাঁধিলে না!
আমার সুরের ইন্দ্রাণী ওগো! ব্যথার সাগর-তলে–
দেখেছি কি কত না-বলা কথার মুক্তা মানিক জ্বলে?
তোমার কন্ঠে মালা হয়ে তারা মুক্তি লভিতে চায়
গত জনমের অস্থি আমার নিদারুণ বেদনায়
মুক্তা হয়েছে; অঞ্জলি দিতে তাই গাঁথি গানে গানে
চরণে দলিয়া ফেলে দিয়ো পথে যদি তা বেদনা হানে।
মনে করো, দুঃস্বপ্নের মতো আমি এসেছিনু রাতে
বহুবার গেছ ভুলিয়া এবারও ভুলিয়া যাইয়ো প্রাতে
কহিলাম যত কথা প্রিয়তমা মনে কোরো সব মায়া,
সাহারা মরুর বুকে পড়ে না গো শীতল মেঘের ছায়া!
মরুভূর তৃষা মিটাইবে তুমি কোথা পাবে এত জল?
বাঁচিয়া থাকুক আমার রৌদ্রদগ্ধ আকাশতল!
নজরুলের প্রেমের কবিতা গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।