শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প রামের সুমতি, কবি তার অধিকাংশ গল্প, উপন্যাসের কাহিনি গ্রহণ করেছেন নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভব থেকে। কোনো রাজা-রানীর কাহিনি নয়, একান্তই নিজের ঘরের মানুষ তার পাত্র-পাত্রী। তার সকল রচনাতেই সাধারণ বাঙালি পাঠক গল্পের ও বই পড়ার আনন্দ পেয়েছেন। তার গল্পে প্রকাশিত হয় পাড়াগাঁয়ের গরিব মানুষ ও গৃহস্থের মনোবেদনার কাহিনি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প রামের সুমতি
প্রথম পরিচ্ছেদ
রামলালের বয়স কম ছিল, কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধি কম ছিল না। গ্রামের লোকে তাহাকে ভয় করিত। অত্যাচার যে তাহার কখন কোন্ দিক দিয়া কিভাবে দেখা দিবে, সে কথা কাহারও অনুমান করিবার জো ছিল না। তাহার বৈমাত্র বড়ভাই শ্যামলালকেও ঠিক শান্ত-প্রকৃতির লোক বলা চলে না, কিন্তু, সে লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড করিত না। গ্রামের জমিদারী কাছারিতে সে কাজ করিত এবং নিজের জমিজমা তদারক করিত। তাহাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল। পুকুর, বাগান, ধানজমি, দু’-দশ ঘর বাগদী প্রজা এবং কিছু নগদ টাকাও ছিল।শ্যামলালের পত্নী নারায়ণী যেবার প্রথম ঘর করিতে আসেন,—সে আজ তের বছরের কথা—সেই বছরে রামের বিধবা জননীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি আড়াই বৎসরের শিশু রাম এবং এই মস্ত সংসারটা তাঁহার তেরো বছরের বালিকা পুত্রবধূ নারায়ণীর হাতে তুলিয়া দিয়া যান।
এ বৎসর চারিদিকে অত্যন্ত জ্বর হইতেছিল। নারায়ণীও জ্বরে পড়িলেন। তিন-চারিটা গ্রামের মধ্যে একমাত্র খানিকটা-পাশকরা ডাক্তার নীলমণি সরকারের একটাকা ভিজিট দু’টাকায় চড়িয়া গেল এবং তাঁহার কুইনিনের পুরিয়া অ্যারারুট ও ময়দা সহযোগে সুখাদ্য হইয়া উঠিল। সাতদিন কাটিয়া গেল, নারায়ণীর জ্বর ছাড়ে না। শ্যামলাল চিন্তিত হইয়া উঠিলেন।
বাড়ির দাসী নৃত্যকালী ডাক্তার ডাকিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আজ তাঁকে ভিন গাঁয়ে যেতে হবে—সেখানে চার টাকা ভিজিট—আসতে পারবে না।
শ্যামলাল ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, আমিও না হয় চার টাকাই দেব, টাকা আগে, না প্রাণ আগে? যা তুই, চামারটাকে ডেকে আন গে।
নারায়ণী ঘরের ভিতর হইতে সে কথা শুনিতে পাইয়া ক্ষীণস্বরে ডাকিয়া বলিলেন, ওগো, কেন তুমি অত ব্যস্ত হচ্চ? ডাক্তার না হয় কালই আসবে, একদিনে আর কি ক্ষেতি হবে?
রামলাল উঠানের একধারে পিয়ারা তলায় বসিয়া পাখির খাঁচা তৈরি করিতেছিল, উঠিয়া আসিয়া বলিল, তুই থাক নেত্য, আমি যাচ্চি।
দেবরটির সাড়া পাইয়া উদ্বেগে নারায়ণী উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ওগো, রামকে মানা কর। ও রাম, মাথা খাস আমার, যাসনে—লক্ষ্মী ভাইটি আমার, ছি দাদা, ঝগড়া করতে নেই।
রাম কর্ণপাতও করিল না—বাহির হইয়া গেল। পাঁচ বছরের ভ্রাতুষ্পুএ তখনও কাঠিগুলা ধরিয়া বসিয়া ছিল, কহিল, খাঁচা বুনবে না কাকা?
বুনবো অখন, বলিয়া রাম চলিয়া গেল।
নারায়ণী কপালে করাঘাত করিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, কেন তুমি ওকে যেতে দিলে? দেখ, কি কাণ্ড বা করে আসে।
শ্যামলাল ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়াই ছিলেন, রাগিয়া বলিলেন, আমি কি করব? তোমার মানা শুনল না, আমার মানা শুনবে?
হাত ধরলে না কেন? ও হতভাগার জন্যে আমার একদণ্ডও যদি বাঁচতে ইচ্ছা করে! ও নেত্য, লক্ষ্মী মা আমার, দাঁড়িয়ে থাকিস নে—ভোলাকে পাঠিয়ে দে গে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনুক—সে হয়ত এখনো গরু নিয়ে মাঠে যায়নি।
নেত্যকালী ভোলার সন্ধানে গেল।
রাম নীলমণি ডাক্তারের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাক্তার তখন ডিস্পেন্সারিতে, অর্থাৎ একটা ভাঙ্গা আলমারির সামনে একটা ভাঙ্গা টেবিলে বসিয়া নিক্তিহাতে ঔষধ ওজন করিতেছিলেন। চারি-পাঁচজন রোগী হাঁ করিয়া তাহাই দেখিতেছিল। ডাক্তার আড়চোখে চাহিয়া নিজের কাজে মন দিলেন।
রাম মিনিট-খানেক চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বৌদির জ্বর সারে না কেন?
ডাক্তার নিক্তিতে চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়াই বলিলেন, আমি কি করব—ওষুধ দিচ্ছি—
ছাই দিচ্ছ! পচা ময়দার গুঁড়োতে অসুখ ভালো হয়!
কথা শুনিয়া নীলমণি ওজন, নিক্তি সব তুলিয়া চোখ রাঙ্গা করিয়া বাক্যশূন্য হইয়া চাহিয়া রহিলেন। এত বড় শক্ত কথা মুখে আনিবার স্পর্ধা যে সংসারের কোন মানুষের থাকিতে পারে, তিনি তাহা জানিতেন না।
ক্ষণেক পরে গর্জিয়া উঠিলেন, পচা ময়দার গুঁড়ো, তবে নিতে আসিস কেন রে? তোর দাদা পায়ে ধরে ডাকতে পাঠায় কেন রে?
রাম বলিল, এদিকে আর ডাক্তার নেই, তাই ডাকতে পাঠায়। থাকলে পাঠাত না।
লোকগুলা স্তম্ভিত হইয়া শুনিতেছিল, তাহাদিগের পানে চাহিয়া দেখিয়া সে পুনর্বার বলিল,—তুমি ছোট জাত, বামুনের মান-মর্যাদা জান না, তাই বলে ফেললে,—পায়ে ধরে ডাকতে পাঠায়। দাদা কারো পায়ে ধরে না। আসবার সময় বৌদি মাথার দিব্যি দিয়ে ফেলেছে, নইলে দাঁতগুলো তোমার সদ্যই ভেঙ্গে দিয়ে ঘরে যেতুম। তা শোন, ভাল ওষুধ নিয়ে এখনি এস, দেরি ক’রো না। আজ যদি জ্বর না ছাড়ে, ঐ যে সামনে কলমের আমবাগান করেচ, বেশী বড় হয়নি ত,—ও কুড়ুলের এক-এক ঘায়েই কাত হবে—ওর একটিও আজ রাত্তিরে থাকবে না। কাল এসে এই শিশিবোতলগুলো গুঁড়ো করে দিয়ে যাব। বলিয়াই সে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
ডাক্তার নিক্তি ধরিয়া আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিলেন।
একজন বৃদ্ধ তখন সাহস করিয়া বলিল, ডাক্তারবাবু, আর বিলম্ব ক’রো না। ভাল ওষুধ লুকানো-টুকানো যা আছে, তাই নিয়ে যাও। ও রামঠাকুর—যা বলে গেছে তা ফলাবে, তবে ছাড়বে।
ডাক্তার নিক্তি রাখিয়া বলিলেন, আমি থানায় দারোগার কাছে যাব, তোমরা সব সাক্ষী।
যে বৃদ্ধ পরামর্শ দিতেছিল, সে বলিল, সাক্ষী! সাক্ষী কে দেবে বাবু? আমার ত কুইনাইন খেয়ে কান ভোঁভোঁ করতেছে—রামঠাকুর কি যে বলে গেল, তা শুনতেও পেলুম না। আর দারোগা করবে কি বাবু? ও দেবতাটি দেখতে ছোট, কিন্তু ওনার বাগদী ছোকরার দলটি ছোট নয়। ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারলে থানার লোক দেখতে আসবে না, দারোগাবাবু এক আঁটি খড় দিয়ে উপকার করবে! ও-সব আমরা পারব না—ওনাকে সবাই ডরায়। তার চেয়ে যা বলে গেছে, তাই কর গে। একবার হাতটা দেখ দেখি আপনি—আজ দুখানা রুটি-টুটি খাব নাকি?
ডাক্তার অন্তরে পুড়িতেছিলেন, বুড়ার হাত দেখিবার প্রস্তাবে দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন, সাক্ষী দিবিনে তোরা? তবে দূর হ’ এখান থেকে। আমি কারুর হাত দেখতে পারব না—মরে গেলেও কাউকে ওষুধ দেব না—দেখি, তোদের কি গতি হয়।
বৃদ্ধ লাঠিটা হাতে লইয়া উঠিয়া পড়িল—দোষ কারো নয় ডাক্তারবাবু, উনি বড় শয়তান। ঠাকুরকে খবরটা একবার দিয়েও যেতে হবে, না হলে, হয়ত বা মনে করবে, থানায় যাবার মতলব আমরাই দিয়েছি। বিঘেটাক বেগুন-চারা লাগিয়েছি—বেশ ডাগর হয়েও উঠেছে—হয়ত আজ রাত্তিরেই সমস্ত উপড়ে রেখে যাবে। বাগদী ছোঁড়াগুলো ত রাত্তিরে ঘুমোয় না। বাবু, থানায় না হয় আর একদিন যেয়ো—আজ এক শিশি ওষুধ নিয়ে গিয়ে ওনারে ঠান্ডা করে এসো।
বৃদ্ধ চলিয়া গেল, আর যাহারা ছিল, তাহারাও সরিয়া পড়িতে লাগিল। নীলমণি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া, মানবজীবনের শেষ অভিজ্ঞতা—সংসারের সর্বোত্তম জ্ঞানের বাক্যটি আবৃত্তি করিয়া উঠিয়া বাড়ির ভিতর গেলেন,—দুনিয়ার কোন শালার ভাল করতে নেই।
নারায়ণী বাহিরের দিকের জানালায় চোখ রাখিয়া ছটফট করিতেছিলেন। রাম বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া ডাকিল—গোবিন্দ, খাঁচা ধরবি আয়।
নারায়ণী ডাকিলেন, ও রাম, একবার এদিকে আয়।
রাম কঞ্চির মধ্যে সাবধানে কাঠি পরাইতে পরাইতে বলিল, এখন না, কাজ কচ্চি।
নারায়ণী ধমক দিয়ে বলিলেন, আয় বলচি শিগগির।
রাম কাঠিগুলা নামাইয়া রাখিয়া বৌদির ঘরে গিয়া তক্তপোশের একধারে পায়ের কাছে গিয়া বসিল।
নারায়ণী জিজ্ঞাসা করিলেন, ডাক্তারের সঙ্গে তোর দেখা হ’ল?
হাঁ।
কি বললি তাঁকে?
আসতে বললুম।
নারয়ণী বিশ্বাস করিলেন না—শুধু আসতে বললি—আর কিছু বলিস নি?
রাম চুপ করিয়া রহিল।
নারায়ণী বলিলেন, বল না, কি বলেছিস তাঁকে?
বলব না।
নৃত্যকালী ঘরে ঢুকিয়া সংবাদ দিল—ডাক্তারবাবু আসচেন।
নারায়ণী মোটা চাদরটা টানিয়া লইয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন। রাম ছুটিয়া পলাইয়া গেল। অনতিকাল পরেই ডাক্তার লইয়া শ্যামলাল ঘরে ঢুকিলেন। ডাক্তার কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করিয়া, পরিশেষে নারায়ণীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, বৌমা, জ্বর সারা না-সারা কি ডাক্তারের হাতে? তোমার দেওরটি ত আমাকে দু’টি দিনের সময় দিয়েছে। এর মধ্যে সারে ভাল, না সারে ত আমার ঘর-দোরে আগুন ধরিয়ে দেবে।
নারায়ণী লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিলেন, ওর ঐ-রকম কথা, আপনি কোন ভয় করবেন না।
ডাক্তার বলিলেন, লোকে বলে ওর একটা দল আছে। তাদের যে-কথা, সেই কাজ। তাতেই বড় শঙ্কা হয়, মা! আমরা ওষুধই দিতে পারি, প্রাণ দিতে পারিনে।
নারায়ণী চুপ করিয়া রহিলেন।
শ্যামলাল রুষ্ট হইয়া বলিলেন, ও ছোঁড়া একদিন জেলে যাবে তা জানি, কিন্তু ঐ সঙ্গে আমাকেও না যেতে হয়, তাই ভাবি।
আজ নীলমণি শোবার ঘরের সিন্দুক খুলিয়া আসল কুইনিন এবং টাটকা ঔষধ আনিয়াছিলেন, তাহাই ব্যবস্থা করিয়া ফিরিবার সময় শ্যামলাল চার টাকা ভিজিট দিতে গেলে, তিনি জিভ কাটিয়া বলিলেন, সর্বনাশ! আমার ভিজিট ত এক টাকা। তার বেশী আমি কোনমতেই নিতে পারব না—ও অভ্যাস আমার নেই। শ্যামবাবু, টাকা দু’দিনের কিন্তু ধর্মটা যে চিরদিনের।
দুই দিন পূর্বে এইখানেই যে এক টাকার অধিক আদায় করিয়া লইয়াছিলেন, আজ সে কথাও তিনি বিস্মৃত হইলেন। কিন্তু শ্যামলাল সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইলেন। যাহা হউক, নারায়ণী আরোগ্য হইয়া উঠিলেন, এবং সংসার আবার পূর্বের মতই চলিতে লাগিল।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প
রামের সুমতি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মাস-দুই পরে একদিন তিনি নদী হইতে স্নান করিয়া পূর্ণকলস নামাইয়া রাখিয়াই বলিলেন, নেত্য, সে বাঁদরটা কোথায়?
বাঁদরটা যে কে, তাহা বাটীর সকলেই জানিত।
নেত্য বলিল, ছোটবাবু এই ত ছিল—ঐ যে ওখানে ঘুড়ি তৈরি কচ্চে।
নারায়ণী দেখিতে পাইয়া ডাকিলেন, ইদিকে আয় হতভাগা, ইদিকে আয়। তোর জ্বালায় কি আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব?
রামলাল আধখানা বেলের ভিতর হইতে কাঠি দিয়া খুঁচাইয়া আঠা বাহির করিতে করিতে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
নারায়ণী বলিলেন, সাঁতরাদের এক মাচা শশাগাছ কেটে দিয়ে এসেছিস কেন?
তারা আমাকে কাটতে দেখেছে?
তারা দেখেনি, আমি দেখেছি। কেন কেটেছিস বল্?
আমাকে বুড়ী মাগী অপমান করলে কেন?
নারায়ণী জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, অপমানের কথা পরে হবে—তুই চুরি কচ্ছিলি কেন, তাই আগে বল্?
রামলাল রীতিমত বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, চুরি কচ্ছিলুম? কখ্খন না! এতটুকু একটু শশা নিলে বুঝি চুরি করা হয়?
নারায়ণী আরো জ্বলিয়া বলিলেন, হাঁ বাঁদর! এক শ’বার হয়। বুড়ো-ধাড়ী, কাকে চুরি করা বলে, ঐ কচি ছেলেটা জানে। দাঁড়িয়ে থাক্ এক-পায়ে, পাজী, দাঁড়া বলচি। এ বাড়িতে কচি খোকা গোবিন্দ ছিল রামের বাহন। চব্বিশ ঘন্টাই সে কাছে থাকিত এবং সব কাজে সাহায্য করিত। রামের হুকুম মত এতক্ষণ সে ঘুড়ি ধরিয়া ছিল, গোলমাল শুনিয়া সেটা ছাড়িয়া দিয়া মায়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
রাম ইতস্ততঃ করিতেছে দেখিয়া চট করিয়া বলিল, কাকা, দাঁড়াও এক-পায়ে—এমনি করে। বলিয়া সে একটা পা তুলিয়া দাঁড়াইবার প্রণালীটা দেখাইতেছিল—
রাম ঠাস করিয়া তাহার গালে একটা চড় কষাইয়া দিয়া পিছন ফিরিয়া এক-পায়ে দাঁড়াইল।
নারায়ণী হাসি চাপিয়া ছেলেকে কোলে তুলিয়া লইয়া রান্নাঘরে গিয়া ঢুকিলেন। মিনিট-দুই পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, সে তেমনই করিয়াই এক-পায়ে দাঁড়াইয়া, কোঁচার খুঁট দিয়া ঘন ঘন চোখ মুছিতেছে।
নারায়ণী বলিলেন, আচ্ছা যা, হয়েছে। আর এমন করিস নে।
রাম সে কথা শুনিল না। রাগ করিয়া তেমনিভাবে এক-পায়ে দাঁড়াইয়া চোখ মুছিতে লাগিল।
নারায়ণী কাছে আসিয়া তাহার বাহু ধরিয়া টানিতে গেলেন, সে শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া প্রবলবেগে ঝাড়া দিয়া তাঁহার হাত সরাইয়া দিল; তিনি হাসিয়া আর একবার টানিবার চেষ্টা করিতেই সে পূর্বের মত সবেগে ঝাড়া দিয়া নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া এক দৌড়ে বাহিরে পলাইয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেক পরে নৃত্যকালী ডাকিতে আসিয়া দেখিল, চন্ডীমন্ডপের ও-ধারের বারান্দায় পা ঝুলাইয়া খুঁটি ঠেস দিয়া রাম চুপ করিয়া বসিয়া আছে।
নৃত্যকালী বলিল, ইস্কুলের সময় হয়নি ছোটবাবু? মা ডাকচেন।
রাম জবাব দিল না। যেন শুনিতেই পায় নাই, এইভাবেই বসিয়া রহিল।
নৃত্য সামনে আসিয়া বলিল, মা চান করে খেয়ে নিতে বলচেন।
রাম চোখ রাঙ্গাইয়া গর্জিয়া উঠিল, তুই দূর হ।
কিন্তু মা কি বলেচেন শুনতে পেয়েচ?
না, পাইনি। আমি নাব না, খাব না—কিছু করব না—তুই যা।
আমি গিয়ে বলচি তাঁকে, বলিয়া নৃত্যকালী ফিরিতে উদ্যত হইল।
রাম তৎক্ষণাৎ উঠিয়া খিড়কির এঁদো-পুকুরে ডুব দিয়া আসিয়া ভিজা মাথায় ভিজা কাপড়ে বসিয়া রহিল। নারায়ণী খবর পাইয়া ব্যাকুল হইয়া ছুটিয়া আসিলেন—ওরে ও ভূত! ও কি করলি? ও ডোবাটায় ভয়ে কেঊ পা ধোয় না, তুই স্বচ্ছন্দে ডুব দিয়ে এলি?
তিনি আঁচল দিয়া বেশ করিয়া তাহার মাথা মুছাইয়া দিয়া, কাপড় ছাড়াইয়া ঘরে আনিয়া ভাত বাড়িয়া দিলেন। রাম বাড়া-ভাতের সুমুখে গোঁজ হইয়া বসিয়া রহিল।
নারায়ণী তাহার মনের ভাবটা বুঝিয়া কাছে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, লক্ষ্মী ভাইটি, এ-বেলা তুই আপনি খা, রাত্তিরে তখন আমি খাইয়ে দেব। চেয়ে দেখ এখনো আমার রান্না শেষ হয়নি—লক্ষ্মীটি খাও!
রাম তখন ভাত খাইয়া জামা পরিয়া ইস্কুলে চলিয়া গেল।
নৃত্যকালী কহিল, তোমার জন্যই ওর সব-রকম বদ অভ্যাস হচ্চে মা! অত বড় ছেলেকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দেওয়া কি! একটু রাগ করলেই খাইয়ে দিতে হবে—ও আবার কি কথা!
নারায়ণী একটু হাসিয়া বলিলেন, না হলে খায় না যে। রাত্তিরের লোভ না দেখালে ও ঐখানে একবেলা ঘাড় গুঁজে বসে থাকতো—খেত না।
নৃত্যকালী বলিল, না, খেত না! ক্ষিদে পেলে আপনি খেত। অত বড় ছেলে—
নারায়ণী মনে মনে অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, তোরা ওর বয়সই দেখিস! বড় হলে, বুদ্ধি হলে ওর আপনিই লজ্জা হবে। তখন আর কোলে বসতে চাইবে, না, খাইয়ে দিতে বলবে?
নৃত্যকালী ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, ভালর জন্যই বলি মা, নইলে আমার দরকার কি? ষোল-সতর বছর বয়সে যদি ওর জ্ঞান-বুদ্ধি না হয়, তবে হবে কবে?
নারায়ণী এবার রাগ করিলেন। বলিলেন, জ্ঞান-বুদ্ধি সকল মানুষের এক সময়ে হয় না নেত্য। কারো বা দু’বছর আগে, কারো বা দু’বছর পরে হয়। আর হোক ভাল, না হোক ভাল, তোদেরই বা এত দুর্ভাবনা কেন?
নেত্য বলিল, ঐ তোমার দোষ মা। ও যে কি-রকম দুষ্টু হয়ে উঠেচে তা ত নিজেও দেখতে পাচ্চ। পাড়ার লোকে বলে, তোমার আদরেই ও—
নারায়ণী রুক্ষস্বরে বলিলেন, পাড়ার লোকে আদরটাই দেখে, শাসনটা দেখে না।
কিন্তু তুই ত পাড়ার লোক ন’স, সমস্ত সকালবেলাটা যে এক-পায়ে দাঁড়িয়ে কাঁদলে, পচা পুকুরে ডুব দিয়ে এল, ভগবান জানেন, জ্বর হবে, না কি হবে, তার পরে কি বলিস উপোস করিয়ে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিতে? ঘরে-বাইরে আমার অত গঞ্জনা সহ্য না, নেত্য। বলিতে বলিতে তাঁহার স্বর রুদ্ধ হইয়া দুই চোখ জলে ভরিয়া আসিল, আঁচল দিয়া চোখ মুছিলেন।
এই কথা লইয়া কাল রাত্রে স্বামীর সঙ্গেও যে সামান্য কলহ হইয়া গিয়াছিল, সে কথা নেত্য জানিত না। অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত হইয়া সে বলিল, ও কি মা, কাঁদ কেন? মন্দ কথা ত আমি কিছু বলিনি। লোকে বলে, তাই একটু সাবধান করে দেওয়া।
নারায়ণী চোখ মুছিয়া বলিলেন, সকল মানুষকে ভগবান একরকম গড়েন না। ও একটু দুষ্টু বলেই আমি যার তার কথা চুপ করে সহ্য করি, কিন্তু আদর দেবার খোঁটা লোকে দেয় কি ব’লে? তারা কি চায়, ওকে আমি কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসি? তা হলেই বোধ করি, তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হ্য়। বলিয়া কোনরূপ উত্তরের প্রতীক্ষামাত্র না করিয়া তিনি দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।
নেত্যকালী এতটুকু হইয়া গিয়া মনে মনে বলিতে লাগিল, জানি না বাপু! সব বিষয়ে যে-মানুষের এত বুদ্ধি, এত ধৈর্য, সে কেন এইটুকু কথা বুঝতে পারে না ? আর শাসন ত ভারী! ছেলে এক মিনিট এক-পায়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেচে ত পৃথিবী রসাতলে গেছে!
দাদার সঙ্গে বসিয়া আহার করিতে রাম একেবারে পছন্দ করিত না। আজ রাত্রে ইছা করিয়াই নারায়ণী দুই ভাইয়ের খাবার পাশাপাশি দিয়া অদূরে বসিয়াছিলেন। রাম ঘরে ঢুকিয়াই লাফাইয়া উঠিল। যাও, আমি খাব না—কিছুতেই খাব না।
নারায়ণী বলিলেন, তবে শুগে যা।
তাঁহার গম্ভীর কন্ঠস্বরে রামের লাফানি বন্ধ হইল, কিন্তু, সে খাইতে বসিল না—চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
রান্নাঘরে আর একটা দরজা দিয়া শ্যামলাল ঘরে ঢুকিতেই রাম ঝড়ের মত বাহির হইয়া গেল। শ্যামলাল ধীরে-সুস্থে খাইতে বসিয়া বলিলেন, রেমো খেলে না যে?
নারায়ণী সংক্ষেপে বলিলেন, ও আমার সঙ্গে খাবে।
আহার শেষ করিয়া শ্যামলাল চলিয়া যাইবামাত্রই রাম একমুঠো ছাই লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আমি কাউকে খেতে দেব না—সকলের পাতে ছাই দিয়ে দেব—দিই?
নারায়ণী মুখ তুলিয়া বলিলেন, দিয়ে একবার মজা দেখ না!
রাম ছাই-মুঠা হাতে করিয়া সুর বদলাইয়া বলিল, ভারী মজা, সকালবেলা আমাকে ঠকিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়ে এখন মজা দেখ না!
তুই খেলি কেন?
তুমি যে বললে রাত্তিরে—
বুড়ো খোকা, পরের হাতে খেতে তোর লজ্জা করে না?
রাম আশ্চর্য হইয়া বলিল, পরের হাতে কোথায়! তুমি যে বললে!
নারায়ণী আর তর্ক না করিয়া বলিলেন, আচ্ছা, যা—ছাই ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে আয়। কিন্তু আর কোনদিন খেতে চাস্!
খাওয়ানো তখনো শেষ হ্য় নাই, নৃত্যকালী বিনা প্রয়োজনে একবার দরজায় সম্মুখ দিয়া ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ও-দিকের বারান্দায় চলিয়া গেল।
নারায়ণী দেখিয়া বলিলেন, রাম, কখনও কি একটু শান্ত হবিনে ভাই! ভগবান কোনদিন কি তোর একটু সুমতি দেবেন না? লোকের কথা যে আমি আর সহ্য করিতে পারিনে।
রাম মুখের ভাত গিলিয়া লইয়া বলিল, কে লোক তার নাম বল।
নারায়ণী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—বাস্! কে লোক, ওকে তার নাম বলে দাও!
কিন্তু মাস-কয়েক পরে সত্যই নারায়ণীর অসহ্য হইয়া উঠিল। তাঁহার বিধবা মা দিগম্বরী দশ বছরের কন্যা সুরধুনীকে লইয়া এতদিন কোনমতে তাঁহার ভাইয়ের বাড়িতে দিন কাটাইতেছিলেন। হঠাৎ সেই ভাইটির মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার আর দাঁড়াইবার স্থান রহিল না। নারায়ণী স্বামীকে সম্মত করাইয়া তাঁহাদিগকে আনাইতে লোক পাঠাইয়া দিলেন। তাঁহারা আসিলেন এবং আসিয়াই দিগম্বরী মেয়েকে ত ডিঙাইয়া গেলেনই, সেই সুবাদে রামকেও ডিঙাইবার জন্য পা বাড়াইতে লাগিলেন। প্রথম হইতেই তিনি রামকে বিদ্বেষের চোখে দেখিতে লাগিলেন।
আজ সকালবেলা রাম দুই-তিন হাত একটা অশ্বত্থ-চারা আনিয়া উঠানের মাঝখানে পুঁতিতে আরম্ভ করিয়া দিল। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া দিগম্বরী মালা ঘুরাইতে ঘুরাইতে সমস্ত লক্ষ্য করিয়া তীক্ষ্ণস্বরে বলিলেন, ওটা কি হচ্চে রাম?
রাম তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিল, অশ্বত্থ-গাছটা বড় হলে বেশ ছায়া হবে গো! মাস্টারমশাই বলেছে, অশথের ছায়া খুব ভাল। গোবিন্দ যা, ঘটি করে জল নিয়ে আয়। ভোলা, মোটা দেখে একটা বাশঁ কেটে আন—বেড়া দিতে হবে। নইলে গরুবাছুরে খেয়ে ফেলবে।
দিগম্বরী হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গিয়া বলিলেন, উঠানের মাঝখানে অশ্বত্থ-গাছ! এমন ছিষ্টিছাড়া কান্ড কখনও বাপের বয়সে দেখিনি বাবা!
রাম সে কথায় কর্ণপাতও করিল না।
গোবিন্দ তাহার সামর্থ্যানুযায়ী একটি ছোট ঘটি করিয়া জল আনিয়া উপস্থিত করিয়াছিল। রাম তাহার হাত হইতে ঘটিটি লইয়া সস্নেহে হাসিয়া বলিল, এটুকু জলে কি হবে রে পাগলা! তুই বরং দাঁড়া এইখানে, আমি জল আনি গে।
তাহার পর ঘড়া ঘড়া জল ঢালিয়া সমস্ত উঠানটা কাদা করিয়া, রাম যখন গাছ-পোঁতা শেষ করিয়াছে, তখন নারায়ণী নদী হইতে স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিলেন। দিগম্বরী এতক্ষণ তুঁষের আগুনে দগ্ধ হইতেছিলেন, কারণ তাঁহার চোখের সুমুখেই এই হিতকর বিরাট অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হইয়া প্রায় সমাধা হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি মেয়েকে দেখিতে পাইয়াই চীৎকার করিয়া উঠিলেন, দেখ্ নারাণি, চেয়ে দেখ্! তোর দেওরের কাণ্ডটা একবার দেখ্। উঠানের মাঝখানে অশ্বত্থ-গাছ পুঁতে বলে কিনা ছায়া হবে।
আবাব ওদিকে চেয়ে দেখ্ হারামজাদা ভোলার কাণ্ড। একটা আস্ত বাঁশঝাড় কেটে নিয়ে ঢুকছে—বেড়া দেওয়া হবে।
নারায়ণী চাহিয়া দেখিলেন, সত্যই একরাশ বাঁশ ও কঞ্চি টানিয়া আনিয়া ভোলা উঠানে ঢুকিতেছে। ভোলা রামের প্রায় সমবয়সী। নারায়ণী হাসিতে লাগিলেন। ওদিকে মায়ের ক্রুদ্ধ ব্যস্ত ভাব, এদিকে রামের এই পাগলামি, সমস্ত জিনিসটাই তাঁহার কাছে পরম হাস্যকর ব্যাপার বলিয়া ঠেকিল। হাসিয়া বলিলেন, উঠানের মাঝধানে অশ্বত্থ-গাছ কি হবে রে?
রাম আশ্চর্য হইয়া বলিল, কি হবে কি বৌদি! কেমন চমৎকার ঠাণ্ডা ছায়া হবে বল ত, আর এই যে ছোট ডালটি দেখচ, উটি বড় হলে,—এই গোবিন্দ, আঙ্গুল দেখাস নে—বড় হলে গোবিন্দর জন্যে একটা দোলা টাঙ্গিয়ে দেব। ভোলা, একটু উঁচু করে বেড়া দিতে হবে, নইলে কালী গলা বাড়িয়ে খেয়ে নেবে; দে কাটারিখানা, আমার হাতে দে, তুই পারবি নে। খটখট ঠকঠক করিয়া বাঁশ কাটা শুরু হইয়া গেল।
নারায়ণী হাসিতে হাসিতে কক্ষস্থিত পূর্ণকলস রান্নাঘরে রাখিয়া দিতে চলিয়া গেলেন।
রাগে দিগম্বরীর চোখ জ্বলিতে লাগিল। মেয়ের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, তুই যে কিছু বললি নে? ঐখানে তবে অশ্বত্থ-গাছ হোক?
নারায়ণী হাসিয়া বলিলেন, মা, ব্যস্ত হ’চ্চ কেন, অত বড় গাছ কখন হয়? ওর কি শেকড়-বাকড় আছে যে ঘড়া ঘড়া জল ঢাললেই বাঁচবে? ও ত কালই শুকিয়ে যাবে।
দিগম্বরী কিছুমাত্র শান্ত না হইয়া বলিলেন, শুকুবে না ছাই হবে, ভাল চাস ত উপড়ে ফেলে দে গে!
নারায়ণী শঙ্কিত হইয়া বলিলেন, বাপরে! তা হ’লে আর কারো রক্ষে থাকবে না।
দিগম্বরী বলিলেন, কেন, বাড়ি কি ওর একলার যে মনে করলেই উঠোনের মাঝখানে এক অশ্বত্থ-গাছ পুঁতে দেবে! তোরা কি কেউ ন’স? আমার গোবিন্দ কি কেউ নয়? মা গো, অশ্বত্থ-গাছের উপরে এসে রাজ্যের কাক, চিল, শকুনি বাসা করবে, হাড়গোড় ফেলে নোঙরা করবে—আমি ত নারাণি, তা হলে থাকতে পারব না! ওকে তোদের এত ভয়টা কি জন্যে শুনি? আমার যদি বাড়ি হ’ত, নারাণি, তা হলে দেখতুম, ও কতবড় বজ্জাত। একদিনে সোজা করে দিতুম।
নারায়ণী মায়ের বুকের ভিতরটা যেন দর্পণের মত স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জোর করিয়া হাসিয়া বলিলেন, ছেলেমানুষ, ওর এখন বুদ্ধি কি মা! বুদ্ধি থাকলে কি কেউ নিজের বাড়ির উঠোনে অশ্বত্থ-গাছ পোঁতে? দু’দিন থাক, তার পরে ও আপনিই ফেলে দেবে।
দিগম্বরী বলিলেন, ফেলে দেবে। ও কেন দেবে, আমি নিজেই দেব।
নারায়ণী কহিলেন, না মা, ও-কাজ করো না, তোমাকে বলচি, ওকে চেন না। আমি ছাড়া ওর বড়ভাইও ছুঁতে সাহস করবে না মা! আজকার দিনটা যাক।
দিগম্বরী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তুই কাপড় ছাড়্ গে যা।
দুপুরবেলা নারায়ণী নিজের ঘরে বসিয়া বালিশের অড় সেলাই করিতেছিলেন, নেত্য ছুটিয়া আসিয়া খবর দিল, মা, সর্বনাশ হয়েচে! দিদিমা ছোটবাবুর গাছ ফেলে দিয়েছে। সে ইস্কুল থেকে এসে কাউকে বাঁচতে দেবে না! নারায়ণী সেলাই ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন, সত্যই গাছটি নাই।
বলিলেন, মা রামের গাছ কি হ’ল?
দিগম্বরী মুখ হাঁড়িপানা করিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিলেন, ওই।
নারায়ণী কাছে আসিয়া দেখিলেন, সেটি শুধু তুলিয়া ফেলা হয় নাই, মুচড়াইয়া ভাঙ্গিয়া রাখা হইয়াছে। তখনই নিঃশব্দে তুলিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিয়া নারায়ণী ঘরে চলিয়া গেলেন।
ইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া রাম সর্বাগ্রে তাহার গাছটি দেখিতে গিয়া একেবারে লাফাইয়া উঠিল। বই-খাতা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, বৌদি, আমার গাছ?
নারায়ণী রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া বলিলেন, বলচি, এদিকে আয়।
না, যাব না। কৈ আমার গাছ?
এদিকে আয় না, বলচি।
রাম কাছে আসিতেই তিনি হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গিয়া কোলের উপর বসাইয়া, মাথায় মুখে হাত বুলাইয়া বলিলেন, মঙ্গলবারে কি অশ্বত্থ-গাছ পুঁততে আছে রে?
রাম শান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কি হয়?
নারায়ণী হাসিয়া বলিলেন, তা হলে বাড়ির বড়বৌ মরে যায় যে!
রাম একমুহূর্তে ম্লান হইয়া গিয়া বলিল, যাঃ, মিছে কথা।
নারায়ণী হাসিমুখে বলিলেন, না রে, মিছে কথা নয়, পাঁজিতে লেখা আছে।
কৈ, পাঁজি দেখি?
নারায়ণী মনে মনে বিপদ্গ্রস্ত হইয়া অকস্মাৎ গভীর বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তুই কি ছেলে রে! মঙ্গলবার পাঁজির নাম করতেও নেই—তুই দেখবি কি রে? এ কথা যে ভোলাও জানে! আচ্ছা, ডাক তাকে।
এত বড় অজ্ঞতা পাছে ভোলার কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে, এই ভয়ে সে তৎক্ষণাৎ অপ্রতিভ হইয়া তাহার দুই বাহু দিয়া মাতৃসমা বড়বধূর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া বলিল, এ আমিও জানি। কিন্তু ফেলে দিলে আর দোষ নেই, না বৌদি?
নারায়ণী তাহার মাথাটা বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, না, আর দোষ নেই। তাঁহার চোখ দুটি জলে ভিজিয়া উঠিল। মৃদুকন্ঠে বলিলেন, হাঁ রে রাম, আমি মরে গেলে তুই কি করিস?
রাম সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, যাঃ—বলতে নেই।।
নারায়ণী অলক্ষ্যে চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া বলিলেন, বুড়ো হলুম, মরব না রে!
এবারে রাম পরিহাস বুঝিতে পারিয়া মুখ তুলিয়া সহাস্যে বলিল, তুমি বুড়ো বুঝি? একটি দাঁতও পড়েনি, একটি চুলও পাকেনি।
নারায়ণী বলিলেন, চুল না পাকতেই আমি নদীর জলে একদিন ডুবে মরব। নাইতে যাব, আর ফিরে আসব না।
কেন বৌদি?
তোর জ্বালায়! আমার মাকে তুই দেখতে পারিস নে, দিনরাত ঝগড়া করিস, সেইদিন তোরা টের পাবি, যেদিন আমি আর ফিরব না।
কথাটা রাম বিশ্বাস করিল না বটে, তথাপি মনে মনে শঙ্কিত হইয়া বলিল, আচ্ছা আমি আর কিছু বলব না। কিন্তু ও কেন আমাকে অমন ক’রে বলে?
বললেই বা। উনি আমার মা, তোরও গুরুজন। আমাকে যেমন তুই ভালবাসিস, ওঁকেও তেমনি ভালবাসবি। বল্ বাসবি?
রাম আবার বৌদিদির বুকের মধ্যে মুখ লুকাইল। এইখানে মুখ রাখিয়া, সে এই দীর্ঘ তেরো বৎসর বাড়িয়া উঠিয়াছে, কেমন করিয়া সে এত বড় মিথ্যা কথা মুখে আনিবে! এ যে তাহার পক্ষে একেবারেই অসাধ্য!
নারায়ণী আর্দ্রকণ্ঠে বলিলেন, মুখ লুকালে কি হবে, বল্?
ঠিক এই সময়ে দিগম্বরী দেখা দিলেন। কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বলিলেন, কাজকর্ম নেই নারাণি! দেওরকে নিয়ে সোহাগ হচ্চে, নিজের ছেলেটা যে ওদিকে সারা হয়ে গেল।
রাম তৎক্ষণাৎ মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার চোখ দুটা হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল।
নারায়ণী জোর করিয়া তাহার মুখ বুকের উপর টানিয়া লইয়া মাকে বলিলেন, ছেলেটা সারা হয়ে গেল কিসে?
কিসে? বেশ! বলিয়াই দিগম্বরী প্রস্থান করিলেন।
বানাইয়া বলিবার মত একটা মিথ্যাকথাও তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না। রাম জোর করিয়া মাথা তুলিয়া বলিল, ও ডাইনির আমি গলা টিপে দেব।
নারায়ণী তাহার মুখে হাত চাপা দিয়া বলিলেন, চুপ কর্ পাজি, মা হয় যে!
দিন-চারেক পরে একদিন ভাত খাইতে বসিয়া ‘উঃ আঃ’ করিয়া বার-দুই জল খাইয়া রাম ভাতের থালাটা টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া নাচিতে লাগিল—ঐ ডাইনী-বুড়ীর রান্না আমি খাব না, কখ্খন খাব না, ঝালে মুখ জ্বলে গেল, বৌদি—ও—বৌদি—
চীৎকার-শব্দে নারায়ণী আহ্নিক ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া পড়িলেন।
কি হ’ল রে?
রাম রাগে কাঁদিয়া ফেলিল—আমি কখ্খন খাব না, কখ্খন খাব না—ওকে দূর করে দাও। বলিতে বলিতে ঝড়ের বেগে সে বাহির হইয়া গেল।
নারায়ণী স্তম্ভিত হইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া কহিলেন, মা, বার বার বলি, তরকারিতে এত ঝাল দিও না, অত ঝাল খাওয়া এ বাড়ির কারো অভ্যাস নেই।
দিগম্বরী অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন, ঝাল আবার কোথায়? দুটি লঙ্কা শুধু গুলে দিয়েচি, এতেই এত কাণ্ড!
নারায়ণী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, নাই দিলে মা দুটো লঙ্কা। কেউ যখন খায় না, তখন—
চুপ কর্ নারাণি, চুপ কর্। রান্না শিখোতে আসিস নে আমাকে, চুল পাকালুম এই করে, এখন পেটের মেয়ের কাছে রান্না শিখতে হবে। ধিক্ আমাকে!
নারায়ণী আর কোন কথা না বলিয়া রান্নাঘরে গিয়া নূতন করিয়া রাঁধিবার যোগাড় করিতে লাগিলেন।
দিগম্বরী দুয়ারে পা ছড়াইয়া বসিয়া কপালে করাঘাত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন, ভাই রে! কোথায় আছিস, একবার ডেকে নে! আর সহ্য হয় না। যা মুখে আসে, আমাকে তাই বলে গাল দেয় রে! আমি বুড়ী! আমি ডাইনী! আমাকে দূর করে দিতে বলে। আমি এমন মেয়ে-জামায়ের ভাত খেতে এসেচি—আমার গলায় দেবার দড়ি জোটে না! এর চেয়ে পথে ভিক্ষে করা শতগুণে ভাল। সুরো, আয় মা, আমরা যাই, এ বাড়িতে আর জলস্পর্শ করব না।
সুরধুনী কাঁদ-কাঁদ হইয়া মায়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, দিগম্বরী তাহার হাত ধরিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।
নারায়ণী বঁটি কাত করিয়া রাখিয়া উঠিয়া আসিয়া পথরোধ করিয়া দাঁড়াইলেন।
দিগম্বরী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, না, আটকাস্ নে আমাদের নারাণি, যেতে দে। আমরা অনাহারে গাছতলায় মরব সেও ভাল, কিন্তু তোদের ভাত খাব না, তোদের ঘরে শোব না।
নারায়ণী হাতজোড় করিয়া কহিলেন, কার ওপর রাগ করে যাচ্চ মা? আমরা কি কোন অপরাধ করেছি?
দিগম্বরীর ক্রন্দন অধিকতর উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, নাকিসুরে বলিলেন, আমি কচি খুকি নই, নারাণি, সব বুঝি। তোর ইশারা না থাকলে কি ওর কখন অত সাহস হয়? আমি ডাইনী! অ্যাঁ, আমাকে দূর করে দাও! আচ্ছা, তাই যাচ্ছি। আমরা তোদের আপদ-বালাই—গলগ্রহ! পথ ছাড় বলচি।
নারায়ণী মায়ের দুই পায়ে হাত দিয়া বলিলেন, মা, আজকের মত মাপ কর। আচ্ছা, উনি আসুন, তার পরে যা ইচ্ছে হয় ক’রো। তাহার পর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া, দুই পায়ে জল ঢালিয়া আঁচল দিয়া মুছাইয়া লইয়া একটা পিঁড়ির উপর বসাইয়া পাখা লইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন।
ক্রোধটা তাঁহার তখনকার মত শান্ত হইল বটে, কিন্তু দুপুরবেলা শ্যামলাল আহারে বসিতেই তিনি কপাটের অন্তরালে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। প্রথমটা শ্যামলাল হতবুদ্ধি হইয়া চাহিয়া রহিলেন, পরে একটু একটু করিয়া সমস্ত ব্যাপারটা অবগত হইয়া অর্ধভুক্ত অন্ন ফেলিয়া রাখিয়া উঠিয়া গেলেন।
নারায়ণী বুঝিলেন এ রাগ কাহার উপরে। নৃত্যকালী সহ্য করিতে পারিল না। বাড়ির মধ্যে সে ছিল স্পষ্টবাদিনী, চট করিয়া বলিয়া বসিল, দিদিমা, জেনেশুনে ইচ্ছে করে বাবাকে খেতে দিলে না! চোখের জল ত তোমার শুকিয়ে যাচ্ছিল না দিদিমা, না হয় দু’মিনিট পরেই বার করতে!
দিগম্বরী মুখ কালি করিয়া নিরুত্তরে বসিয়া রহিলেন।
দুপুরবেলা রাম কোথা হইতে ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিয়া, এ-ঘর ও-ঘর খুঁজিয়া তাহার বৌদিদির ঘরে আসিয়া দেখিল, তিনি গোবিন্দকে লইয়া শুইয়া আছেন। ব্যাপারটা তাহার বড় ভাল বোধ হইল না। তথাপি আস্তে আস্তে বলিল, ক্ষিদে পায় যে!
বৌদিদি কথা কহিলেন না।
সে আর একটু জোর করিয়া বলিল, কি খাব?
নারায়ণী শুইয়া থাকিয়াই বলিলেন, আমি জানিনে, যা এখান থেকে।
না, যাব না—আমার ক্ষিদে পায় না বুঝি!
নারায়ণী মুখ ফিরাইয়া রুষ্টভাবে বলিলেন, আমাকে জ্বালাতন করিস নে রাম, নেত্য আছে, তাকে বল্ গে।
রাম আর কিছু না বলিয়া বাইরে আসিয়া নেত্যকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া বলিল, খেতে দে নেত্য।
নেত্য বোধ করি প্রস্তুত হইয়াই ছিল; এক বাটি দুধ, কিছু মুড়ি ও চার-পাঁচটা নারকেলের নাড়ু আনিয়া দিল।
রাম রাগিয়া উঠিয়া বলিল, এই বুঝি?
নেত্য বলিল, ছোটবাবু, ভাল চাও ত আজ আর হাঙ্গামা ক’রো না। বাবু না খেয়ে কাছারি চলে গেছে, মা উপোস করে গোবিন্দকে নিয়ে শুয়ে আছে। গোলমাল শুনে যদি উঠে আসে—তোমার অদেষ্টে দুঃখ আছে তা বলে দিচ্চি।
রাম তাহা দেখিয়াই আসিয়াছিল, আর দ্বিরুক্তি না করিয়া খানিকটা দুধ খাইয়া মুড়ি ও নাড়ু কোঁচড়ে ঢালিয়া লইয়া পুকুরধারে গাছতলায় গিয়া বসিল। তাহার আহারে প্রবৃত্তি চলিয়া গিয়াছিল। বৌদি উপোস করিয়া আছে। সে অন্যমনস্ক হইয়া মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে ভাবিতে লাগিল, তাহার মুনি-ঋষিদের মত কোন একটা মন্ত্র জানা থাকিলে এইখানে বসিয়াই সে বৌদির পেট ভরাইয়া দিত। কিন্তু, মন্ত্র না জানিয়া কি উপায়ে যে কি করা যায়, ইহা সে কোনমতে স্থির করিতে পারিল না।
ফিরিয়া গিয়া তাঁহাকে খাইবার জন্য অনুরোধ করিতে তাহার লজ্জা করিতেও লাগিল। তা ছাড়া দাদা যে খায়নি! অনুরোধ করিলেই বা কি হইবে? সে কোঁচড় হইতে মুড়ি প্রভৃতি জলের উপর ছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কেবলই মনে হইতে লাগিল, বৌদি উপোস করিয়া আছে। কথাটা সে মনে মনে যত রকম করিয়াই আবৃত্তি করিল, ততবারই তাহার মনের মধ্যে ছুঁচ ফুটিল।
রাত্রে শ্যামলাল ভার্যাকে বলিলেন, আমার আর সহ্য হয় না। ওকে নিয়ে আর বাস করা চলে না।
নারায়ণী অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কার কথা বলচ?
রামের কথা। তোমার মা আমাকে চার-পাঁচ দিন ধরে ক্রমাগত বলচেন, রাম ওঁকে নাহক অপমান করচে। আমি পাঁচজন ভদ্রলোক ডেকে বিষয়-আশয় সমস্ত ভাগ করে ওকে আলাদা করে দেব। আমি আর পারিনে।
নারায়ণী স্তম্ভিত হইয়া ক্ষণকাল বসিয়া থাকিয়া বলিলেন, রামকে আলাদা করে দেবে? ও-কথা মুখেও এনো না। ও দুধের ছেলে, বিষয়-আশয় নিয়ে কি করবে শুনি?
শ্যামলাল বিদ্রুপ করিয়া বলিলেন, দুধের ছেলেই বটে! আর বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ও কি করবে, সে ও-ই জানে।
নারায়ণী বলিলেন, ও জানে না, আমি জানি। কিন্তু মা বুঝি তোমাকে চার-পাঁচ দিন ধরে ক্রমাগত ওই কথা বলে বেড়াচ্চেন?
শ্যামলাল একটু অপ্রতিভ হইয়া ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, না, উনি কিছুই বলেন না, লোকেরও ত চোখ আছে গো! আমি নিজে কি কিছুই দেখতে পাইনে, তাই তুমি মনে কর?
নারায়ণী বলিলেন, না, আমি তা মনে করিনে। কিন্তু ওর কে আছে, কাকে নিয়ে ও পৃথক হবে? মা আছে, না বোন আছে, না একটা মাসী-পিসী আছে? ওকে রেঁধে খাওয়াবে কে?
শ্যামলাল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আমি ও-সব জানিনে। মুখে বলিলেন বটে ‘জানি না’, কিন্তু অন্তরে জানিতেছিলেন। এত বড় সত্যটা না জানিয়া পথ কোথায়? নারায়ণী কি কথা বলিতে গেলেন, কিন্তু তাঁহার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল। তাই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, নিজেকে সামলাইয়া লইয়া ভারী গলায় বলিলেন, দেখ, তেরো বছর বয়সে মেয়েরা যখন পুতুল খেলে বেড়ায়, তখন মা আমার মাথায় এই মস্ত সংসারটা ফেলে রেখে স্বচ্ছন্দে স্বর্গে চলে গেলেন। তিনি দেখচেন, এ ভার আমি বইতে পেরেছি কিনা।
রেঁধেচি-বেড়েচি, ছেলে মানুষ করেচি, লোক-লৌকতা, কুটুম্ব, সংসার সমস্তই এই একটা মাথায় বয়ে বয়ে আজ ছাব্বিশ বছরের আধ-বুড়ো মাগী হয়েচি’। এখন আমার ঘরকন্নার মধ্যে যদি হাত দিতে এস, সত্যি বলচি তোমাকে, আমি নদীতে ডুব দিয়ে মরব। তখন আর একটা বিয়ে করে রামকে আলাদা করে দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমনি করে সংসার ক’রো, আমি দেখতেও যাব না, বলতেও যাব না। কিন্তু, এখন নয়।
শ্যামলাল মনে মনে স্ত্রীকে ভয় করিতেন, আর কথা কহিলেন না। কথাটা এইখানেই সে রাত্রে বন্ধ হইয়া রহিল। পরদিন নারায়ণী রামকে কাছে বসাইয়া গভীর স্নেহে গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, রাম, তোর এখানে আর থেকে কাজ নেই ভাই। তুই আলাদা কোথাও আলাদা থাক গে যা—পারবি নে থাকতে?
রাম তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া একগাল হাসিয়া বলিল, পারব বৌদি। তুমি, আমি, গোবিন্দ আর ভোলা, কবে যাওয়া হবে বৌদি?
নারায়ণী নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। ইহার পরে কি বলিবেন তিনি! কিন্তু, রাম কথাটা থামিতে দিল না। সে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছিল, বলিল, কবে যাবে বৌদি?
তিনি সে কথার উত্তরে তাহার মুখটা বুকের উপর টানিয়া লইয়া বলিলেন, তোর বৌদিকে ছেড়ে একলা থাকতে পারবি নে?
রাম মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
আর বৌদি যদি মরে যায়?
যাঃ—
যা নয়। এখন বৌদির কথা শুনিস নে—তখন দেখতে পাবি।
রাম প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কখন তোমার কথা শুনিনে?
নারায়ণী বলিলেন, কখন শুনিস তাই বল্। কতদিন বলেচি, আমার মাকে তুই অপমান করিস নে, তবু তুই তাঁকে অপমান করতে ছাড়বি নে। কালও করেছিস। এইবার আমি যেখানে দু’চোখ যায়, চলে যাব।
আমিও সঙ্গে যাব।
তুই কি টের পাবি কখন যাব! আমি লুকিয়ে চলে যাব।
আর গোবিন্দ?
সে তোর কাছে থাকবে, তুই মানুষ করবি।
না, আমি পারব না বৌদি।
নারায়ণী হাসিয়া বলিলেন, তোকে পারতেই হবে।
তখন রাম সমস্ত কথাটা অবিশ্বাস করিয়া হোহো করিয়া হাসিয়া বলিল, সব মিছে কথা। তুমি কোথাও যাবে না।
মিছে নয়—সত্যি। দেখিস, আমি চলে যাব।
রাম অনুতপ্ত হইয়া বলিল, আর যদি তোমার সব কথা শুনি, তা হলে?
নারায়ণী হাসিমুখে বলিলেন, তা হলে যাব না। তোকেও আর গোবিন্দকে মানুষ করতে হবে না।
রাম খুশী হইয়া বলিল, আচ্ছা, আজ থেকে তুমি দেখো।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প রামের সুমতি আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।